আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার বহুদিনের সংঘাত গত মে থেকে বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলি সেনারা অবস্থানকালে ইরানের রকেট হামলার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। উভয় দেশেই যথেষ্ট সামরিক চাপ রয়েছে। দেশ দুটির মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে কোনো সংঘাত চললে অবশ্যই তা মারাত্মক রক্তক্ষয়ী হবে। সম্প্রতি মার্কিন সাময়িকী নিউজউইকের এক প্রতিবেদনে দুই দেশের সামরিক শক্তির একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে।
অবশ্য এটিও ছিল ইসরায়েলি বাহিনীর ইরানের অবস্থানে বিমান হামলার জবাব। আর তারপর থেকেই ইসরায়েল অনেক বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরিয়ায় অবস্থান নেওয়া ইরানের অন্তত ৫০টি স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরায়েল এমনভাবে বিমান হামলা চালিয়েছে যে ওই সব সামরিক স্থাপনা আবার আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে হয়তো অনেক সময় লেগে যাবে—এমনটাই মত বিশ্লেষকদের।
যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় দুই জাতিই পুরোপুরি যুদ্ধ চাচ্ছে না, তবে ভুল-বোঝাবুঝি দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। উভয় দেশেই যথেষ্ট সামরিক চাপ রয়েছে। দেশ দুটির মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে কোনো সংঘাত চললে অবশ্যই তা মারাত্মক রক্তক্ষয়ী হবে। সম্প্রতি মার্কিন সাময়িকী নিউজউইকের এক প্রতিবেদনে দুই দেশের সামরিক শক্তির একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে।
কার সেনাবাহিনী অধিক শক্তিশালী?
ইসরায়েলের চেয়ে আয়তন ও জনসংখ্যা দুটোতেই বড় ইরান। তবে এমনটা নয় যে জনসংখ্যাই সামরিক সক্ষমতা নির্দেশ করবে। যুদ্ধে উন্নত প্রযুক্তি এবং অভিজ্ঞতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুগ যুগ ধরেই প্রযুক্তিগত সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, কারণ প্রযুক্তিই যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন অপরকে দূর থেকেই আঘাত করা যায়। এ ক্ষেত্রে মানুষের সম্পৃক্ততাও কম হয়।
মাত্র ৮৫ লাখ জনসংখ্যার ছোট্ট একটি দেশ ইসরায়েল। তবে জনসংখ্যা কম হলেও এর সামরিক বাহিনী বেশ ওজনদার। প্রতিবেশী সাত আরব দেশের কোনো সমর্থন না পেয়েও ভালোভাবেই টিকে আছে দেশটি। দ্রুতগতির প্রযুক্তি আর শক্তিশালী পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে দুর্দান্ত যোদ্ধাবাহিনী তৈরি হয়েছে দেশটির। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্য অনুযায়ী ইসরায়েলের প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার সক্রিয় সেনা রয়েছে। এ ছাড়া রিজার্ভে আছে আরও ৪ লাখ ৪৫ হাজার সেনা। সামরিক শক্তির ভিত্তিতে প্রতিবছর তালিকা তৈরি করে ‘গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার’। ১৮ বছর বয়সের মধ্যে ইসরায়েলের সব নন-আরব নাগরিক ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পান। এর ফলে যুদ্ধের সময় একটি বৃহৎ এবং সুপ্রশিক্ষিত বাহিনী সরবরাহ করতে পারে ইসরায়েল।
অপরদিকে ইসরায়েলের চেয়ে কম সুশৃঙ্খল হলেও ইরানি সামরিক বাহিনীকে গণনার বাইরে রাখা যাবে না। ইরানের জনসংখ্যা ৮ কোটি ২০ লাখ। দেশটির সক্রিয় সৈন্য রয়েছে ৫ লাখ ৩৪ হাজার। এ ছাড়া রিজার্ভে রয়েছে ৪ লাখ, যা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বৃহৎ সেনাবাহিনী। সংঘাত সৃষ্টি হলে জনশক্তির বিষয়টি অন্তত গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে ইরানের জনশক্তি হলো ৪ কোটি ৭০ লাখ সেখানে ইসরায়েলের তা ৩০ লাখ। তবে অবশ্যই এটি যুদ্ধের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করবে জনসংখ্যার বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর জন্য ইসরায়েল ব্যয় করেছে সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার। ইরানও এ ক্ষেত্রে খুব বেশি পিছিয়ে নেই, তাদের সামরিক ব্যয় সাড়ে ১৪ বিলিয়ন ডলার। ব্যবধানটা বেশি নয়। তবে ইসরায়েলের সৈন্য সংখ্যা ইরানের চেয়ে অনেক কম। অথচ ইসরায়েল ব্যয় করছে ২ বিলিয়ন ডলার বেশি। অল্পসংখ্যক সেনার জন্য যে মানের প্রযুক্তি ইসরায়েল ব্যবহার করছে, তা অবশ্যই এই বাহিনীকে শক্তিশালী করে তুলছে।
ট্যাংকের সংখ্যাও ইসরায়েলের বেশি—২ হাজার ৭৬০টি, সেখানে ইরানের তা ১ হাজার ৬৫০টি। এ ক্ষেত্রে সংখ্যা ও মান দুদিক দিয়েই এগিয়ে আছে ইসরায়েল। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ভালো মার্কাভা ট্যাংক রয়েছে ইসরায়েলের। সেখানে ইরান বেশির ভাগ সময় দ্বিতীয় মানের ট্যাংক ব্যবহার করে। যদিও ইরান নতুন করে প্ল্যাটফর্ম উন্নয়নের ঘোষণা করেছে। তারা মনে করে, যেকোনো শীর্ষ ক্ষমতার দেশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম তারা।
বিমানবাহীর সক্ষমতায় কে এগিয়ে?
ইসরায়েলের বিমানবাহিনী বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সেরা। সর্বোচ্চ মানের সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা রয়েছে এ বাহিনীতে। এর পাইলটেরাও অত্যন্ত অভিজ্ঞ। সিরিয়া, লেবানন, গাজা এমনকি মিসরের সিনাই উপদ্বীপে লক্ষ্যমাত্রার ওপর নিয়মিত মিশন চালাচ্ছে। এর বহরে রয়েছে এফ-৩৫-এর লাইটিনিং-২ মডেলের আড়াই শ যুদ্ধবিমান। এগুলো পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। এ ছাড়া এফ-৩৫এস মডেলের প্রায় ৫০টি যুদ্ধবিমান রয়েছে।
অপরদিকে ইরানের বহরে রয়েছে ১৬০টি যুদ্ধবিমান। এগুলোর কোনোটিই এফ-৩৫ মডেলের বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন মডেলের নয়। এর পাইলটেরা ইসরায়েলের পাইলটদের চেয়ে কম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ।
নৌবাহিনীর ক্ষেত্রে এগিয়ে ইরান
তবে নৌবাহিনীর ক্ষেত্রে ইরান এগিয়ে থাকলেও দুই দেশের কেউই খুব বেশি শক্তিশালী নয়। ইরানের ৩০টির বেশি সাবমেরিন আছে। ৫টি ফ্র্যাগেট, ৩টি করভেট এবং ২০০ টিরও বেশি পেট্রল ক্র্যাফট আছে। অপরদিকে ইসরায়েলের আছে ৫টি সাবমেরিন, ৩টি করভেট, ৮টি মিসাইল বোট ও ৪৫টি পেট্রল বোট। ভৌগোলিক বিবেচনায়, এই শক্তির নৌবাহিনী কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম নয়।
পারমাণবিক শক্তির দিক দিয়ে
তবে যা-ই হোক না কেন, ট্রাম্প কার্ডটা রয়েছে ইসরায়েলের হাতেই। ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। অপরদিকে ইরানের কোনো পারমাণবিক সক্ষমতা নেই। যদিও বহু বছর ধরে বলা হচ্ছে তেহরানের পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। এ ছাড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছে ইরান। ইসরায়েলে আঘাত হানতে সক্ষম পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে ইরানের—এমন একটি ধারণা করা হয়।
তবে উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কি পিছিয়ে রাখা হবে ইরানকে?
শক্তি আপাতদৃষ্টিতে কম থাকলেও অন্য কৌশল রয়েছে ইরানের। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলবিরোধী গোষ্ঠীগুলো সংঘাতের সময় আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে একজোট হয়ে থাকে, যা ইরানের জন্য বড় শক্তি। বিশেষ করে লেবাননের শিয়া অধ্যুষিত সংগ্রামী সংগঠন হিজবুল্লাহ গ্রুপ ইসরায়েলি নেতাদের জন্য একটি উদ্বেগ। হিজবুল্লাহর একটি সুশিক্ষিত ও সুসংহত সামরিক বাহিনী রয়েছে, যা লেবাননের সেনাবাহিনীর চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম। এই সংগঠনের শক্তিশালী ও বিশাল রকেট অস্ত্রাগার বজায় রাখে, এবং এই অস্ত্র ইসরায়েলের যেকোনো জায়গায় আঘাত করতে পারে। গাজার হামাস ও ফিলিস্তিনের ইসলামি জিহাদি দলগুলোও ইরানকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে কোন দেশ এগিয়ে থাকবে, তা বলা মুশকিল। প্রথম আলো