উল্টোপথের ভিআইপিদের ফেরাতে বিনয়ী পুলিশ কর্মকর্তা

বীরগঞ্জ নিউজ ২৪ ডেস্কঃ

উল্টোপথে আসা একটি ভিআইপি গাড়ি, বনেটে জাতীয় পতাকা; তার সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তা। গাড়িটিকে উল্টোপথ থেকে ঘুরে সোজা রাস্তায় যাওয়ার মিনতিটা ছবিতে স্পষ্ট। জানা যায়, শেষ পর্যন্ত পুলিশ কর্মকর্তার অনড়  অবস্থানে ঘুরেও যায় গাড়িটি। সামাজিক যোগাযোগ্য মাধ্যমে এ ছবি ছড়িয়ে পড়লে ছবির সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে স্যালুট জানিয়ে ধন্যবাদে ভাসিয়েছেন অনেকেই।

রাত সাড়ে ৯টার দিকে দেশের একটী অনলাইন পোর্টালের সাথে কথা হয় ছবিতে থাকা পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি রমনা ট্রাফিক জোনের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (প্রশাসন) তারিকুল আলম সুমন। জানতে চাইলে বলেন, ‘যেকোনো সাধারণ গাড়ি উল্টোপথে এলে আমরা মামলা করে দেই। কিন্তু একজন মন্ত্রীর গাড়ি যখন পুলিশ প্রটেকশন নিয়ে আসে, তখন মামলা করা যায় না। তখনই হাতজোড় করতে হয়, হাতজোড় করে তাদের ঘুরিয়ে দেই।’

আজ বুধবার (৬ জুন) বিকেলেও রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকসহ কয়েকজন মন্ত্রীর গাড়িকে উল্টোপথে আসার কারণে ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে জানান সুমন। আর যে ছবিটি আজ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে, সেটি শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমুর গাড়ি। সুমন বলেন, ‘আমি দেখছিলাম, গাড়ি আসছিল উল্টোপথে। অনেক দূর থেকে হাত দিয়ে ইশারা করে গাড়িটিকে ফিরে যেতে বলা হলেও চালক আমলে নেয়নি। পরে হাতজোড় করেই দাঁড়িয়ে যাই গাড়ির সামনে।’

এ সময় গাড়ি থেকে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা নেমে আসেন। কিন্তু সুমন ছিলেন তার দায়িত্বে অবিচল। খুব বিনয়ের সঙ্গে তিনি ওই কর্মকর্তাকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলে যেতে অনুরোধ জানান। সুমন বলেন, ‘হাতজোড় করে বলেছি, আপনারা যেতে পারবেন না। আমি যেতে দেবো না। পরে তারা গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যায়।’

প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকলে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন তারিকুল আলম সুমন। গত বুধবার থেকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা ও যমুনার মাঝখানের রাস্তাটুকুতে অভিযান চালাচ্ছেন তারা। এ সময় কোনো গাড়িকেই উল্টোপথে যেতে দিচ্ছেন না। অভিযান শুরুর পরদিন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের গাড়িও ঘুরিয়ে দিয়েছেন জানিয়ে সুমন বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী আসছিলেন চারটি গাড়ি নিয়ে। তখন স্যারের গাড়িও ঘুরিয়ে দিয়েছি। তিনি চলে গেছেন।’

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি বেশ সাহসিকতার কাজ— বলতেই এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আসলে সাহসিকতার বিষয় নয়, উল্টোপথে গাড়ি যেতে দেওয়ার জন্য সিনিয়র নির্দেশ দিলে তখন আর কিছু করার থাকে না। কিন্তু দেখা যায়, উল্টোপথে আসা গাড়ির মধ্যে শতকরা ৮০ শতাংশই ভিআইপিদের। তাদের মধ্যে রয়েছেন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সিনিয়র সচিব, পুলিশ কর্মকর্তারা। বাকিরা সাধারণ মানুষ। আমরা সেই ৮০ শতাংশকে কিছুই করি না, বাকি ২০ শতাংশ সাধারণ মানুষের যানবাহনকে মামলা দিয়ে দেই। এটা আমার বিবেকে লাগে।’

সুমন বলতে থাকেন, ‘একজন মন্ত্রীর গাড়ি উল্টোপথে এসে গর্বের সঙ্গে চলে যাচ্ছে, আর আমি একজন সাধারণ মানুষকে ৯০০ টাকার মামলা দিচ্ছি— এটা আমার বিবেককে দংশন করে। তখনই চিন্তা করলাম, মামলা তো করতে পারব না, অন্তত গাড়িগুলো ঘুরিয়ে দিতে পারব। সেই ভাবনা থেকেই এই কাজ করছি।’ তিনি বলেন, ‘স্যারদের সঙ্গে তো আমি সরাসরি কথা বলি না। আবার তাদের গাড়িকে মামলাও দিতে পারব না। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে দেই।’

অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে গত কয়েকদিন এই কার্যক্রমের বেশকিছু ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছেন তারিকুল আলম। তিনি লিখেছেন, প্রতি রমজানেই ইফতারির আগে আগে এ রকম ভিআইপি গাড়ির চাপ থাকে। গতবছরও এরকম অভিযান করেছিলাম। এ বছরও রমজানে গাড়ির চাপ বেড়ে যাওয়ায় উল্টো পথে যাত্রা, সিএনজি স্টেশনে লাইন দিয়ে মূল রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা, অবৈধ পার্কিং— এসব বিষয়ে আমাদের সিনিয়র অফিসারদের টনক নড়ে। স্বভাবতই এসব অভিযান পরিচালনার জন্য আমার ডাক পড়ে। আমিও অনিচ্ছা সত্ত্বেও অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। প্রায় প্রতিটা গাড়িতেই ৯০০ টাকা করে মামলা হলো। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব, সংসদ সদস্য শাওন, সাবেক সংসদ সদস্য পাপিয়া, ঢাকা জেলা জজ, বিচারপতি, গণমাধ্যমের ছোট মাইক্রোবাস, সিএনজি, প্রাইভেটকার ও মোটরবাইক— কিছুই মামলা থেকে রেহাই পায়নি।

সুমন লিখেছেন, আমাদের একজন সিনিয়র মন্ত্রী মহোদয় উল্টোপথে এগিয়ে আসছিলেন। আমিও দুরুদুরু বুকে এগিয়ে গিয়ে বাধা দিলাম এবং বললাম উল্টো গেলে মামলা হবে। উনি খানিকটা হতবাক হয়ে কিছু একটা বলেন (আমি শুনতে পাইনি, হয়তো রাবিশ) গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলেন।

তারিকুল আলম সুমন মনে করেন, সাধারণ মানুষের যানবাহনকে অনেক মামলাই দেওয়া হয়। এর বাইরে যদি দুয়েকজন ভিআইপিকেও মামলা দেওয়া যায় এবং সেটা প্রচারণায় আসে, তবে সাধারণ মানুষের মধ্যেও নিয়ম ভাঙার এই প্রবণতা অনেকটা কমবে। সে কারণেই সবার প্রতি সুমনের আহ্বান, ‘পরিবর্তনের শুরুটা আমাদেরই করতে হবে। শুরুটা না হয় আমিই করে দিলাম, অপেক্ষায় আছি আপনাদের।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *