ডেস্ক রিপোর্টার: গতকাল মঙ্গলবার ঝাড়বাড়ীর প্রসাদ পাড়ার দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র সজীব,বন্ধুদের সাথে নদীতে গোসল করতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যায় । এই ঘটনায় এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া, সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক চাঞ্চল্য। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রতিবেদক গিয়েছিলো সজীবের শোক সন্তপ্ত পরিবারের সাথে কথা বলতে।
আমাদের প্রতিবেদক যখন সজীবের বাড়ীতে গিয়ে পৌছায় তখন সকাল প্রায় এগারোটা বেজে তিরিশ মিনিট। সজীবের বাড়িতে তখনো চলছে শোকের মাতম। বাহির বাড়িতে সজীবের মাকে মাটিতে বসে সন্তান হারানোর শোকে বিলাপ করতে দেখা যাচ্ছে। সজীবের মায়ের সাথে কথা বলার মতো কোন অবস্থা ছিলো না তাই কথা বলতে চাওয়া হলো সজীবের বাবা ইয়াকুব আলীর সাথে। সজীবের বাবাকে ঘরে স্যালাইন লাগিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পরেই ইয়াকুব সন্তান শোকে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে বলে জানান তার পাশে থাকা এক মহিলা আত্নীয়া।
প্রতিবেদককে দেখে ইয়াকুব আলী শোয়া থেকে উঠে বসতে চাইলেন কিন্তু তার শারীরিক অবস্থা ভালো না থাকায় সেটা করতে দেওয়া হলো না। তারপর কোন কিছু জিজ্ঞেস না করতেই সজীবের বাবা আপনা থেকেই বলতে শুরু করেন, “ আমার সব কিছু শেষ ভাই, আমার এক মাত্র সম্বল এই পোলাডাই আছিলো। আমার সব স্বপ্ন এই পোলাডারে নিয়াই। ওহানে যদি এত বড় গর্ত না থাকতো, তাইলে আমার পোলাডা মরতো না! এই চেয়ারম্যানের ওয়ার্ডারে ঐহান থাইকা বালু তুইলা এত বড় গর্ত করছে । এই পোলাডা আমার মরতো না ভাই, যদি খালডা না থাকতো। তারপর ভাঙ্গা গলায় বলতে থাকেন অনেক কথা যেগুলো শেষ পর্যন্ত আর বুঝবার মতো ভাষায় প্রকাশ পায় না। বুঝতে বাকি থাকে না এক মাত্র সন্তান হারানোর শোকে কতটুকু নাজেহাল অবস্থা হয়েছে তার।
আরোও আনুশাঙ্গিক কিছু কথা বলে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে রৌওনা দেওয়া হয় সজীবের মৃতদেহ যেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেই নদীর গর্তের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় বিশ ফিট প্রস্থের নদীটায় সব জায়গায় সর্বোচ্চ কোমড় পরিমাণ পানি। সজীবের লাশ যেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেই জায়গাটায় পানির গভীরতা প্রায় পঁচিশ ফিটের মতো। অন্যান্য জায়গার থেকে নদীর এই স্থানে কেনো এত গভীর গর্ত জানতে চাওয়া হয় নদীর পাহাড়ীতে বাড়ি করে থাকা এক বৃদ্ধা গুলবাহার বেগমের কাছে। তিনি বলেন, “ সরকারী নির্দেশে এহান থাইকা চেয়ারম্যান মিশিন দিয়া বালু তুলছে। সাথে আরোও যোগ করেন, এত বছর থাইকা এখানে আছি এই নদীতে পইড়া একটা পিঁপড়াও মরলো না আর মিশিন দিয়া বালু তুলবার পরে এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এক জলজ্যান্ত পোলা মইরা গেলো গা! এডি কেউ দেখবো না , কেউ কিছু কইবও না ।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নদীর ওপারে এই গভীর গর্তেই পাশেই রয়েছে একটি বৈদ্যুতিক পিলার। যে পিলারের মাধ্যমে এগার হাজার ভোল্টের বৈদ্যুতিক সংযোগ টানানো হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে বন্যার পানি যদি প্রবল স্রোতে প্রবাহিত হয় তবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে বিদ্যুতের পোল এবং সাধারন মানুষ।
বেশ কিছু এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় সবুজ ছাতা ক্লিনিকের ভবন নির্মানের কাজের জন্যে ভুল্লী নদীর ঐ স্থান থেকে মেশিনের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করা হয় দীর্ঘ দিন। সেখানে স্থানীয় ইউনিয়ন প্রশাসনের সহযোগীতাতেই চলে এই বালি উত্তোলনের কাজ। অনেকেই আবার বলেন ‘এখান থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করা হয়েছে প্রতি ট্রাক চার শত টাকা দরে।’ তবে এই তথ্যের কোন প্রমাণ তারা দিতে পারে নাই। আবার কেউ কেউ বলছেন, “জীবন মৃত্যু আল্লাহর হাতে। যদি বাচ্চাটা সেখানে না যাইত তাহলে মরতো না । মরার পরে এটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করার কি দরকার? এই সব চেয়ারম্যানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ছাড়া আর কিছুই না ।”
স্থানীয় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবা ও কল্যান কেন্দ্র (সবুজ ছাতা) ক্লিনিকের ভবন নির্মানের কাজে বালু উত্তোলনের ফলে যে মৃত্যু কূপ তৈরী হয়েছে সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন স্থানীয় এলাকাবাসি। ঝাড়বাড়ী হানিফ কাউন্টারের ম্যানেজার এস,এম সোহাগ এই ব্যাপারে বলেন’, স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগীতায় সেখানে বালি উত্তোলনের ফলে যে গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে সেটা আসলেই অনেক বিপদজনক। আরোও কোন দূর্ঘটনা ঘটার আগেই সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ বলে আমরা মনে করি। ‘
ভুল্লী নদী সংলগ্ন প্রায় এক হাজার মানুষ প্রতিদিন গোসল, গবাদিপশু চরানোসহ নানা ধরনের কাজ কর্ম করে এই নদীর পানিতে। আবার অনেকেই আছেন এই ভরা বন্যার সময় নদী পারি দিয়ে আবাদ করতে ফসলের ক্ষেতে যায়। ভুল্লীপাড়ের এমন আরোও অনেকেরই দাবী এভাবে যেন আর কোথাও বালু উত্তোলন না করা হয় এবং বালু উত্তোলনের ফলে ভুল্লী নদীর যেখানে গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে সেটা যেন দ্রুত ভরাট করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তবে এমন দুর্ঘটনা আরোও হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।