যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কবি শরীফুল আলম বলেছেন, যাঁদের ভেতরে সমৃদ্ধ শব্দ ভাণ্ডার রয়েছে এবং শব্দ নিয়ে যাঁরা খেলা করার কৌশল জানেন কেবল তাঁরাই কবিতা লিখতে পারেন। কবিতার উৎকর্ষতার জন্য কবিতায় ব্যবহৃত অশ্লীল শব্দ নিয়ে আরও গবেষণা করতে চান তিনি। সম্প্রতি প্রকাশিত নতুন দুটি কবিতার বই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে কবি শরীফুল আলম কালের কন্ঠকে এসব কথা বলেন।
কবি শরীফুল আলমের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চারটি। সুড়ঙ্গে মোহনা, The Bloody Heart (ইংরেজি কবিতার বই), ফিরে এসো লাবণ্য এবং অন্তরে অনিন্দিতা। কবিতার বইগুলো দেশে ও প্রবাসে বেশ পাঠক প্রিয়তা এবং সমাদৃত হয়েছে বলে জানালেন কবি।
তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই দুটি নিয়ে কথা হয় তাঁর সাথে। কবিতা সম্পর্কে তাঁর মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন’ যাঁদের ভেতরে সমৃদ্ধ শব্দ ভাণ্ডার রয়েছে এবং শব্দ নিয়ে যাঁরা খেলা করার কৌশল জানেন কেবল তাঁরাই কবিতা লিখতে পারেন। সমসাময়িক কবিদের সম্পর্কে তাঁর মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁদের কবিতা পড়লে ভাবনার উচ্চতা বাড়ে এবং জানার পরিসর বৃদ্ধি।
তিনি বলেন, প্রেমের ব্যাপারে সব কবিরাই কম বেশী একটু অহংকারী হয়ে থাকেন। এমন আভাস ইঙ্গিত ‘ফিরে এসো লাবণ্য’ কাব্যগ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন। তাঁর এই বইয়ের প্রায় সব কটি কবিতাই নান্দনিক কাব্য বিন্যাস রয়েছে। যে ভাষার শব্দ ভান্ডার যত বেশি উন্নত সে ভাষা তত বেশি সমৃদ্ধ তাই এই বইটিতে পুরনো, লোকজ ও বিলুপ্ত প্রায় সেকেলে শব্দ গুলোর ব্যাপক ব্যবহার করেছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
শরীফুল আলমের কবিতা পড়লেই তাঁর কবিত্বের ক্ষমতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর মতে এই উত্তর আধুনিক যুগেও কাব্য ভাষা চর্চায় সনাতনি পদ্ধতিতে উৎকৃষ্ট কবিতা লিখা সম্ভব, তবে কবিতায় ক্রিয়াপদের ব্যবহার এবং দক্ষতা ছাড়া কবি হওয়া সম্ভব নয়। কোন শব্দের পাশে কোন শব্দ মানাবে তা একমাত্র কবিই ভাল বলতে পারবেন।
তাঁর নতুন এ বইতে অনেক অশ্লীল শব্দও ব্যবহার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন অশ্লীল সেটিই সত্য যেটি বাস্তব। যে শব্দ ব্যবহারে কবিতার আকর্ষণ বাড়ে তেমন শব্দ ব্যবহারে অশ্লীলতার কিছু নেই বলে দাবি করেন তিনি। কবিতায় অশ্লীল শব্দ নিয়ে কবিতার উৎকর্ষতার জন্য আমি আরও গবেষণা করতে চাই।
তিনি বলেন শব্দ ব্যবহারে মানুষের চিন্তার বিকাশে ভাষা কতখানি আত্মিক হল সেটিই দেখার বিষয়। দ্রোহ এই শব্দটি অনেক কবিই ব্যবহার করেছেন তা জেনে কিম্বা না জেনে, মূলত দ্রোহ হচ্ছে প্রতিহিংসা তাই এই শব্দটির আমার তীব্র আপত্তি রয়েছে। বাংলা ভাষার একটি স্বতন্ত্র কৌশল আছে, যারা বাংলা ভাষায় চর্চা করেন তাঁদের এই কৌশলটি জানতেই হবে।
গদ্য কবিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন অল্প কথায় পরিমিত বোধের চিত্র শিল্পের যে দর্শন সেটাই আধুনিক গদ্য কবিতা। মূলত বাংলা সাহিত্য জাদুমন্ত্র এবং শ্লোকের হাত ধরেই কবিতার সূত্রপাত হয়েছে, তবে কবিতা হতে হবে সহজ, সরল ও প্রাণবন্ত ভাষায়। অবশ্যই কোন দুর্বোধ্যতা নয় এটি তাঁর দাবি।
কবির মতে মেদবহুল কবিতা এই যুগে অচল। তিনি মনে করেন কবিরা সমাজের অন্যান্য লোকদের মত হলেও তাঁদেরকে লালন করা উচিৎ। কবি জীবনানন্দ ও সুকান্তের মত মৃত্যুর পর তিনি বিখ্যাত হতে চান না। নেট বেইজড সাইট গুলো সাহিত্য চর্চার জন্য একটি ভাল মাধ্যম বলে মনে করেন তিনি। এতে একজন কবি পাঠকের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াও জানতে পারা যায়।
তিনি বলেন, কবিতার সমালোচনা কবির জন্য কল্যাণকর। প্রবাসে সাহিত্যচর্চা খুব কঠিন একটা কাজ। কর্মজীবনে অসম্ভব ব্যস্ত থাকায় লেখালেখির কাজটা শেষ করতে চাইলেও শেষ করা যায় না। কবিতা সমাজ গঠনে অবশ্যই ভূমিকা রাখে। দেশ ও সমাজের ক্লান্তিকালে কবিতা জাতিকে পথ দেখায়। উজ্জিবিত করে। একমাত্র কবিরাই ইশারা ইঙ্গিতে সমাজ পরিবর্তনের সঠিক পথটি বলে দেন।
তিনি বলেন, কবি শব্দটা শুনতে যতই রোমাঞ্চকর লাগুক, আসলে এখনো সেটার যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি। তবে দুরাশা আছে ভবিষ্যতে নামের সঙ্গে ওই রোমাঞ্চকর শব্দটি যোগ করার। দারিদ্রতা প্রতিভা বিকাশকে বিলম্বিত করে, কিন্তু পুরোপুরি অন্তরায় নয়। অনুকূল পরিবেশ পেলে প্রতিভা জ্বলে উঠবেই। ভাষার শালীনতা ও সৌজন্যতা বজায় রেখে কেউ কবিতার সমালোচনা করলে তা সহজেই মেনে নেওয়া যায়।
কবি শরীফুল আলম আক্ষেপ করে বলেন, প্রথম প্রথম কবি হতে হলে নন্দিত হওয়ার চাইতে কপালে নিন্দাই বেশি জোটে, এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই প্রাথমিক কবিদের এগিয়ে যেতে হয়। তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই ‘অন্তরে অনিন্দিতা’ এটি মূলত তাঁর একটি প্রেমের বই। এই বইটিতে তিনি প্রেমকেই বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন। বিশেষ ধারার স্বতন্ত্র কিছু কবিতা তিনি এখানে লিপিবদ্ধ করেছেন।
তার মতে চাইলেই যে কেউ কবিতা লিখতে পারেন কিন্তু চাইলেই যে কেউ কবি হতে পারেন না। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বিভিন্ন ব্লগে লেখালেখি করছেন। অতি সম্প্রতি তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ দুটিতে প্রিয়তামা, ভালবাসা, প্রেম, দেশ, সমসাময়িক বিষয় ও বিশ্ব পরিস্থিতির কথাও তুলে ধরেছেন। ২০১৮ সালে তিনি আরো একটি গবেষণা ধর্মী বড় ভলিয়ম বের করবেন বলে জানিয়েছেন।
কবি শরিফুল আলমের জন্ম ১৯৬০ সালের ৮ আগষ্ট কুমিল্লা জেলার কালিয়াজুরী গ্রামে। পিতা মরহুম হারুনুর রশিদ ও মাতা আয়েশা বেগম। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। কালিয়াজুরী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু। এরপর চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে স্নাতন ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
স্কুল জীবন থেকে লেখালেখি শুরু হয়। অদ্যাবদি সেই চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার কবিতার এ বইগুলো কবিতাপ্রেমীদের কাছে ভালো লাগবে বলে তিনি আশাবাদী। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত। স্ত্রী শাহনাজ বেগমকে নিয়ে ১৯৯৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের রাজধানী আলবেনির পার্শ্ববর্তী শহর হার্ডসনে দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে বাস করছেন। প্রবাসে হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।