মেয়ের জন্য দুর্ভাবনা রফিক সাহেবের এক দিনের নয়। তবু আজকে ভাবনা যেন তাঁর বুকের ভিতর ছুরি দিয়ে কুচিকুচি করে কাটতে লাগল। যতই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে ততই পিতার মন কি এক অপ্রত্যাশিত আশঙ্কায় ভিতরে ভিতরে কাঁপতে লাগল। সন্ধ্যার কালো অন্ধকার তার সারা বুক পর্যন্ত যেন অন্ধকার করে ঘিরে ধরল। তার বন্ধুর সাথে কোথায় গেল,কোথায় যেতে পারে,কোন পার্কে,রেস্টুরেন্টের নির্জন প্রকষ্ঠ,যুবক যুবতী,তিনি আর ভাবতে পারেনা,সমস্ত ভাবনা যেন ঐ পর্যন্ত পৌছে মূচ্ছিত হয়ে পড়ে।
তার ভাবনার মাঝপথে হঠাৎ একটা কালো প্রাচীর উঠে রুখে দাড়ায়,এক অচিন্ত্যনীয় আশঙ্কায় সারা বুক কাঁপতে থাকে। বুকের ভিতর গুমরে গুমরে প্রার্থনা জাগে খোদা তুমি রক্ষা করো,তুমি বাঁচাও আমার মেয়ে কে,আমার মাথা ধূলোয় লুটিয়ে দিও না।
এই ইট কাঠ পাথরের শহরে কোথায় খুজবে মেয়েকে?তবুও পাগলের মতো পুরো শহরে খুজতে থাকে মেয়ে কে,হঠাৎ তার মনে হলো এতক্ষণে তো তারা বাড়ি ফিরতেও পারে,এই জনাকীর্ণ শহরে এভাবে তাকে খুঁজ বেড়ানো পাগলামী ছাড়া আর কিছু নয়!
তার অনুমান মিথ্যা হয়নি,এসেই দেখলো মেয়ে ঘরে ফিরেছে, মেয়ের ঘরে ঢুকে মেয়েকে ডাক দিলেন রুহি! পিতার অস্বাভাবিক কম্পিত স্বর ও অনাবশ্যক উচ্চ ডাকে রুহি হঠাৎ চমকে উঠলো। কোন উত্তর বেরুয়না। দুই বিস্ফোরিত চোখ পিতার মুখের উপর রেখে সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
রফিক সাহেব আবার ডাক দিলেন রুহি-
-আব্বা!
এই কন্ঠস্বরের জন্যই বুঝি রফিক সাহেবের সমগ্র দেহ মন উগ্রীব হয়েছিল। এই কন্ঠস্বরের সামান্য কম্পনের ভিতর দিয়ে মানুষের অন্তরাত্মা প্রতিবিম্বিত হয়ে পড়ে। এই কন্ঠস্বরের সামান্য পরিবর্তনও তিনি বুঝতে পারবেন তার মেয়ে,তার মেয়ে আছে কিনা। কুমারী জীবনের অনির্বচনীয় পবিত্রতা এই কন্ঠস্বরে শুনতে পেয়ে তিনি যেন অকালমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেন।
-তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?
এই বহু বচনের তোমরা শব্দটা যেন রুহির মুখে চড়ের মতো পড়ল। সামলে নিয়ে বলল
-প্রোগ্রাম দেখতে গিয়েছিলাম আব্বা!
আমাকে না বলে কেন গেলে?কিসের প্রোগ্রাম?ইত্যাদি? জিজ্ঞেস করেই তিনি অনর্গল বলতে লাগলেন আর তার দুই চোখ যেন রুহির আপাদমস্তক তন্ন তন্ন করে খুজতে লাগল।তার চুল.মুখ,কাপড়,দুখানি হাত এমন কি জুতোজড়ায় পর্যন্ত পিতার দুই চোখ যেন কী সন্ধান করে ফিরছিল।
এমন করে মেয়েকে কোনদিন তিনি দেখেন নি।
এই অস্বাভাবিক সন্দিগ্ধ ও সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে পিতা আজ কি খুঁজছেন?
অন্যায়ের ইঙ্গিত?পাপের ছায়া?লজ্জার গ্লানিমা?অপমানে লজ্জায় রুহির ভাবনা পর্যন্ত থমকে গেলো।
পিতার সন্দিগ্ধ দৃষ্টি এক মূহুর্তে তার প্রসন্ন মনকে পুড়ে ছাই করে দিলো।
কোন অন্যায় তো সে করেনি!পিতার মুখ বিন্দুমাত্র কালো হতে পারে এমন কোন কাজ তো সে করেনি। তবুও এ অহেতুক সন্দেহ অপমান লজ্জায় সে ফেটে পড়ল।
মেয়ে না হয়ে যদি ছেলে হত তা হলে তাকে না জানিয়ে সারা রাত না ফিরলেও পিতার বা অন্য কারো সন্দিগ্ধ দৃষ্টি তাকে এমন ভাবে দগ্ধ করত না।
-আব্বা তুমি কি আমাকে তোমার ছেলে মনে করতে পার না?
-যা নও তা কি করে মনে করব মা?
স্বাধীনতা মানুষকে মুক্তি দেয়।তবে অতিরিক্ত স্বাধীনতা ধ্বংসের কারন।
-মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলেই কি আমাকে পদে পদে এমনভাবে অপমান সহ্য করতে হবে, আব্বা ?
বলতে না বলতেই হু হু করে তার দু চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো।
রফিক সাহেব কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন,কন্যার মস্তক নিজের বুকে টেনে নিয়ে তার অশ্রু মুছিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি উঠলেন না।
এই ঘটনার পর রুহি আর চার দেয়ালের আবদ্ধ জীবন ছেড়ে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারেনি। কলেজ অঙ্গনেও পরেনি তার পা। দমে গেছে তার স্বপ্ন। থেমে গেছে একজন প্রতিষ্ঠিত নারী হওয়ার ইচ্ছা।
সামান্য স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে তার মুক্তি। কেননা পিতার কথা ছিলো বজ্রের চেয়েও শক্ত,মৃত্যুর মতো ভয়ানক।
হঠাৎ একদিন রুহির বাবা তার বিয়ে দিয়ে দেন। বিদায় বেলা রুহি ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলো।
রফিক সাহেব মনে মনে বলছিলেন,কাঁদুক সে,কাঁদতে শিখুক,এই কান্না তার প্রাপ্য,কান্না মানব হৃদয়ের করুনার প্রতীক। অশ্রু মানব জীবনে বেদনা বোধের উদ্বোধক। আর বেদনার জন্ম মানব জীবনের এক বিরাট উপলবদ্ধি,এই উপলব্ধি মানব জীবনকে মহান করে,পবিত্র করে। হে খোদা রুহির মনেও যেন এ বেদনাবোধ জাগে সে যেন পিতার মনের বেদনা উৎকন্ঠাকে বোঝে, কন্যার জন্য এই আশীর্বাদ করে তিনি বিদায় দিলেন কন্যাকে।
হয়তো রফিক সাহেব কাঁদতে জানেন না তাই তার মনে বেদনাবোধ জন্মেনি। কন্যার স্বপ্ন ভাঙার আকুতি তিনি শুনতে পান নি।তাই কলম কেরে নিয়ে হাতা, খুন্তি গুজে দিয়েছিলেন তার হাতে। কুসংস্কার ধর্মীয় গোড়ামি,আর অবহেলার কারনে আজ অনেক রুহিকে বিসর্জন দিতে হচ্ছে তার স্বপ্ন,তাদের আত্মচিৎকার এই সমাজের কান অবধি পৌছায় না অবলিলায় ঝড়ে পরে অশ্রু হয়ে।
লিখছেনঃ জলস্পর্শী তটিনী