নির্বাচন কোন উৎসব নয়। এটি হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার পূর্বশর্ত বা কিছু সতসিদ্ধ নিয়ম কিংবা আচার আনুষ্ঠানিকতা। সেক্ষেত্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিৎ যথেষ্ট ভাব গাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে।নির্বাচন যত উৎসবমুখর হবে এটি ততই তার নিজস্ব কার্যকারিতা ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হবে। এখন কথা হচ্ছে কি কি ভাবে একটা নির্বাচন তার ‘কার্যকারিতা ও উদ্দেশ্য’ থেকে বিচ্যুত হবে? এটা দেশ, কাল ও ক্ষমতাসীনভেদে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্নভাবে হতে পারে।
ধরুন, আমরা যদি বাংলাদেশের আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে চাই তাহলে উৎসবমুখর নির্বাচনের কারণে “কার্যকারিতা ও উদ্দেশ্য” বিচ্যুত হবার কারণগুলো হবে আলাদা। আবার অন্য কোনো দেশের নির্বাচন উৎসবমুখর হলে সেখানকার “কার্যকারিতা ও উদ্দেশ্য” বিচ্যুত হবার কারণগুলো হবে আলাদা। তবে সেটা বাংলাদেশই হোক আর নেপালই হোক, নির্বাচন যদি ‘উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা’ থেকে বিচ্যুত হয় তবে সেটার সুবিধা পাবার ধরণ ও সুবিধাভোগীরা কিন্তু একই হয়।
এখন আসি বাংলাদেশে উৎসবমুখর নির্বাচন হলে সেটা কিভাবে একটা ‘কার্যকারিতা ও উদ্দেশ্য’ বিচ্যুত নির্বাচন হবে কিংবা বাংলাদেশে কি আসলেই নির্বাচনটা উৎসবমুখর হচ্ছে কি না? দুটো প্রশ্নের উত্তরই হচ্ছে “হ্যা”।
“হ্যা” হবার কারণ আবার দুইটি; এক, দেশটির জন্মলগ্ন থেকেই এখানে নির্বাচনকে উৎসব হিসেবে গ্রহণ করা হয়। মূলত এই দেশে নির্বাচনটাকে উৎসব হিসেবে নিতে শেখানো হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে কিভাবে শেখানো হয়েছে?
এবার আসি সেই কথায়, নির্বাচনের মাধ্যমে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে যারা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যান তারা নির্বাচনের পরেই নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভুলে ব্যক্তিস্বার্থের আখের গুছাতে থাকেন। একবার নির্বাচিত হয়ে পরের নির্বাচনের ঠিক আগ মূহুর্ত পর্যন্ত ক্ষমতাওয়ালাদের আর ভোটারদের কথা মনে থাকে না কিন্তু পরের নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলে তো তাদের আবার ভোটারদের দরকার হয়। এই যে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেও যারা আবার ভোটারদের কাছে যায় তাদের কল্যাণেই আসলে নির্বাচনটা উৎসবমুখর হয়।
যখন তারা ওয়াদা বরখেলাপি প্রতিনিধি হয়ে একাধিকবার ভোটারদের নিকট যায় তখন তাদের দরকার পরে কিছুটা ভিন্নতার। এই ভিন্নতাটা আবার স্থানীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচনে আলাদা রকম হয়। যেমন, স্থানীয় নির্বাচনে চা-জিলাপী আর মাংস-ভাতের আয়োজন করে প্রার্থীরা ভোটারদের খাওয়ায় আর বাজারগুলোতে নির্দিষ্ট প্রার্থীদের আলাদা আলাদা দোকান বরাদ্দ করা থাকে যেখানে স্থানীয় ভোটারদের জন্যে বিকেল থেকে সন্ধ্যে রাত পর্যন্ত ভোটাররা প্রতিনিধিদের টাকায় চা-বিস্কুট খায় আর রাজনীতির প্রলাপ বিলায়। এদেশের মানূষদের কাছে উৎসব মানেই জিলেপি-বিস্কুট আর মাংস-ভাতে বলিহারি। এই উৎসব, এই খাওয়া-দাওয়া মানেই একটা উন্মাদনা আর উন্মাদনাতেই ভুল সিদ্ধান্তটা বেশি নেয় মানুষ।
এবার আসি দুই নম্বর কারণে- স্থানীয় নির্বাচনের পরে সব থেকে বড় উৎসবমুখর নির্বাচন হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই পর্যায়ে আবার নির্বাচনটাকে উৎসবমুখর করতে অবলম্বন করা হয় ভিন্ন পন্থা বা স্থানীয় উভয় পন্থাই। বাংলাদেশ জন্মের পর থেকে ঠিক এবারের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বাদে যতগুলো গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন হয়েছে সেগুলোকে উৎসবমুখর করতে যে পদ্ধতিগুলো অবলম্বল করা হয়েছে সেগুলো মোটাদাগে বলতে গেলে একই রকম ছিলো। যার মধ্যে পরে, সমস্ত পাঁচ বছরে যদি একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য তার নির্বাচনি এলাকায় নাও যান কিন্তু ঠিক নির্বাচনের আগ মূহুর্তে সেই সাংসদ তার নিজ এলাকায় ঠিকই হাজির হন তার দলের হাই কমান্ড বা সর্বোচ্চ জনপ্রিয় নেতাকে নিয়ে। এক্ষেত্রে দেখা যায়,সড়ক ও যোগাযোগমন্ত্রীকে ঐ সাংসদ নিয়ে গেছেন একটা কালভার্ট নির্মাণের উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে। সেই দশ বাই চার মিটার কালভার্ট উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে স্বয়ং সড়ক-সেতু ও যোগাযোগমন্ত্রী এসেছেন! ভাবা যায়? আবার এই উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে করা হয়েছে ভরপেট খুরমা বা জিলাপি খাওয়ার আয়োজন সাথে রয়েছে কুরআন ও গীতা পাঠ শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যেখানে গান ও নাচ পরিবেশন করবেন দেশ বরেণ্য, পর্দা কাপানো জনপ্রিয় শিল্পীবৃন্দ!
অধরা এমপি-মন্ত্রীকে কাছে পেয়ে বহুল কাঙ্ক্ষিত কালভার্ট নির্মাণ কাজ ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে ভোটাররা উৎসবের উন্মাদনায় ভোগে এবং ক্ষমতাসীনদের বিগত ভুলত্রুটি যদি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে থাকে তাহলে এখানে উৎসবমুখর নির্বাচনটা আসলে কোন ভুমিকা পালন করলো?
বিগত জাতীয় নির্বাচনগুলোর উৎসবমুখরতা আর এবারের একাদশতম জাতীয় নির্বাচনের উৎসবমুখরতার মধ্যে আমার উল্লেখ করা সব বৈশিষ্ট্য উপস্থিত আছে এতে কোন সন্দেহ নাই তবে নতুন একটা সুক্ষ্ণ বিষয় বা বৈশিষ্ট্য এখানে যোগ করা হয়েছে সেটা মনে হয় অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।
যদি বোঝার ভুল না থাকে তাহলে দুই একটা উদাহারণসহ কার্যকারণ ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হলো- স্বাধীনের পরে এই দেশে মোট নির্বাচন হয়েছে ১০ বার তার মধ্যে আটটি নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস ছিল প্রায় একই রকম। আর ১/১১ পরবর্তি দুটি নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস হচ্ছে আরেক রকম, যা বিগত আটটি নির্বাচনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বিগত দুই নির্বাচনের পরে ক্ষমতাসীনদের অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে শুধু উৎসবমুখর পরিবেশে আর নিজেদের অতীত ঢাকা যাচ্ছে না এবার দরকার মহাউৎসব। আর এই মহাউৎসবের দ্বারও খুলতে শুরু করেছে সময়ের সাথে সাথে। আর এই দ্বারের প্রথম চমক হচ্ছে মাশরাফি, দুই শাকিব-সাকিব ও হিরো আলমরা।
এই মাশরাফি,শাকিব ও হিরো আলমরা আসন্ন একাদশতম জাতীয় নির্বাচনের মোড়টাই ঘুরিয়ে দিয়েছে। ধীরে ধীরে এই মোড় ঘোরানোদের কাতার হয়তো আরো লম্বা হবে। ভাবছেন, কিভাবে তারা এই নির্বাচনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো? এটাও একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ১/১১ পূর্ববর্তী আটটি নির্বাচন আর পরবর্তি দুইটি নির্বাচনের আলোকে একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে সাধারণ জনগণের মাঝে যে আশা-আকাঙ্ক্ষার বা শঙ্কাগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবার কথা ছিল সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। জনগণ এখন মাশরাফি আর হিরো আলমকে নিয়েই আলোচনায় ব্যস্ত! এখন বলবেন না আবার মাশরাফি আর হিরো আলম বাদে অন্য কি নিয়ে আলোচনা হবার কথা ছিলো? যেটা নিয়ে আলোচনা হবার কথা সেটা সবাই জানে কিন্তু বলে না। যেমন এই লেখাতেও সেটা কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
জনতার জন্যে মাশরাফি আর হিরো আলমকে নির্বাচনে এনে নির্বাচনটাই জনতার থেকে যোজন যোজন দূরে সরিয়ে নেওয়া হলো না তো আবার?