কিছু অদ্ভুত ব্যাপার আছে ছেলেটার বোলিংয়ে। দীর্ঘ রানআপ তো আছেই, সেই রানআপের শুরুতে এক পা আরেক পায়ের সামনে এনে ক্রস চিহ্নের মতো কিছু একটা করেন। এরপর দৌড় শুরু। কিন্তু দৌড়টা বল ডেলিভারির আগে কেমন যেন থেমে যায়! তবে বলটা হয় ভালো। বিসিবি উত্তরাঞ্চলের এই পেসারকে নিয়ে বিসিএলজুড়েই কৌতূহল—ছেলেটা কে?
নাম শরীফুল ইসলাম। বাড়ি পঞ্চগড়। বয়স প্রায় ১৭ বছর। উচ্চতা ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি। পঞ্চগড়ের কালীগঞ্জ টেকনিক্যাল কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র। তবে এসব পরিচয় আস্তে আস্তে ঢাকা পড়তে শুরু করেছে তাঁর বোলার পরিচয়ের আড়ালে। বিসিএলে এখন পর্যন্ত দুই ম্যাচ খেলে নেন ৯ উইকেট, এক ম্যাচেই সাতটি। প্রিমিয়ার লিগে প্রাইম ব্যাংকের হয়ে আট ম্যাচে ১৭ উইকেট। তার আগে এবারের জাতীয় লিগেও রাজশাহীর হয়ে খেলেছেন চার ম্যাচ, অর্জন ২৪.৫৪ গড়ে ১১ উইকেট।
অথচ ২০১৬ ও ২০১৭ মৌসুমেও তিনি ছিলেন তৃতীয় বিভাগের ক্রিকেটার। খেলেছেন শেখ রাসেলে। গত জাতীয় লিগে নেট বোলার হিসেবে ডাক পড়ে রাজশাহী বিভাগীয় দলের অনুশীলনে। শরীফুলের জন্য বাকিটা স্বপ্নযাত্রা। বিসিএলে তাঁর অধিনায়ক জহুরুল ইসলাম কাল খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে বলছিলেন সেই স্বপ্নযাত্রার কথা, ‘এর আগে তৃতীয় বিভাগ ছাড়া ও কোথাও খেলেনি। ওকে নেটে দেখে আমি অনুরোধ করে জাতীয় লিগের দলে নিই। খুব ভালো বল করল। প্রিমিয়ার লিগেও আমি তাকে আমার দলে (গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স) নিতে চেয়েছিলাম। পরে প্রাইম ব্যাংকে খেলে।’
তৃতীয় বিভাগ থেকে সরাসরি জাতীয় লিগে খেলার ঘটনা বিরলই বলতে হবে। বিসিবির নিয়ম অনুযায়ী কমপক্ষে প্রথম বিভাগের খেলোয়াড় না হলে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলা যায় না। শরীফুল অভাবিত সুযোগটা পেয়েছেন জহুরুলের চেষ্টায়। এটা নিয়ে কিছু সমালোচনাও নাকি তখন হয়েছে।
শরীফুলের বোলিংয়ের সবচেয়ে বড় অস্ত্র গতি। জোরে বল করা এই তরুণের নেশা। এই বয়সেই বলের গতি কখনো কখনো ১৩০-এর কাছাকাছি উঠে যায়। জড়তা নেই কথাবার্তায়ও, ‘চার দিনের খেলায় বেশি বোলিং করা যায়। বেশি বোলিং মানে বেশি মজা। খুব মজা লাগছে বিসিএলে খেলতে।’ শরীফুলের মজা বেড়ে যায় যখন বল তাঁর কথা শোনে, ‘ব্যাটসম্যানের সামনে বল ফেলে সুইং করাতে, বাউন্স দিতে ভালো লাগে আমার। এক দিনের খেলায় কাটারও মারি। তবে আমার বেশি ভালো লাইন-লেংথ।’
শরীফুলের আরেক অস্ত্র শর্ট বল। এ কারণেই যখন বলেন, মুমিনুল হককে বল করাটা বেশি কঠিন মনে হয়, তখন বিস্ময় জাগে। শরীফুলের যে উচ্চতা, তাতে ছোটখাটো গড়নের মুমিনুলেরই তো উল্টো তাঁকে ভয় পাওয়ার কথা! শরীফুল হেসে বলেন, ‘উনি কখন কোনটা মারবেন, বোঝা যায় না।’
আর ওই যে রানআপের শুরুতে পা দিয়ে ক্রস চিহ্নের মতো করা, ডেলিভারির আগে দৌড়ের গতি কমে যাওয়া, এসব কেন হয়? শরীফুলের ভাষায় ক্রস চিহ্নের ব্যাপারটা ‘অটোমেটিক’ হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই এটা তাঁর অভ্যাস। তবে ২৭ কদম দীর্ঘ রানআপে হঠাৎ দৌড়ের গতি কমিয়ে ফেলাটাকে সমস্যা বললেন তিনিও, ‘এটা জড়তা থেকে হয়। সাবলীল ভাবটা একটু নষ্ট হয়ে যায় তখন। কাজ করলে এটা ঠিক হয়ে যাবে।’
বিসিএলে শরীফুলের বোলিং কোচ মাহবুব আলী জাকি। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটেও আছেন তাঁর হাতেই। গত পেস বোলিং ক্যাম্প থেকে হাইপারফরম্যান্স কোচ চম্পকা রমানায়েকেরও চোখ আছে শরীফুলের ওপর। রানআপে হঠাৎ গতি কমে যাওয়ার একটা ব্যাখ্যা দিলেন জাকি, ‘ওর ছয়টা বলের রানআপ অনেক সময় ছয় রকমও হয়। ও কী বল করবে, সেটার ওপর রানআপ নির্ভর করে। সে জন্যই কখনো কখনো মেলাতে পারে না।’
তরুণ এই পেসারকে নিয়ে তাঁর কোচদের স্বপ্ন অনেক বড়। জাকি বলছিলেন, ‘সুযোগ পেলে পরবর্তী অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সে-ই হতে পারে আমাদের মূল স্ট্রাইক বোলার। ছেলেটার মধ্যে পেস বোলারসুলভ আক্রমণাত্মক মানসিকতা আছে।’
বিসিএলে তো সেটা নিয়মিতই দেখাচ্ছেন শরীফুল!
সূত্র : প্রথম আলো