রাশেদ রুম্মান | দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার সনকা ইউনিয়নের রাজিবপুর গ্রামে ৯০ বছরের ঊর্ধ্ব এক বৃদ্ধ বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন তাঁর নিজ ছেলে মাহির উদ্দীন। ঐ বৃদ্ধ এলাকায় গাঠি মোহাম্মদ নামে পরিচিত। গতকাল সোমবার সনকা ইউনিয়নের রাজিবপুর গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ৯০ বছরের গাঠি মোহাম্মদ তাঁর নিজ বাড়ি থেকে একটু দূরে এক ঘুপচি ঘরে ঠাঁই নিয়েছেন। যে ঘরটি কিনা ঐ এলাকার কিছুসংখ্যক তরুণ ছেলে নিজ উদ্যোগে বানিয়ে দিয়েছে।
ঐ বৃদ্ধের বাড়ির আশেপাশের প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ৫-৬ মাস আগে গাঠি মোহাম্মদকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন তাঁর নিজ ছেলে মাহির উদ্দীন। এ নিয়ে এলাকার মানুষজন বৃদ্ধের ছেলে মাহির কে বোঝালেও সে তার বাবাকে ঘরে তুলতে সম্মত হয়নি। আরও জানা যায়, এলাকার মানুষ যখন যা খাবার দিয়ে আসে তা খেয়েই বেঁচে আছেন ঐ বৃদ্ধ লোকটি। বৃদ্ধ বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার আসল কারণ জানতে মাহির উদ্দীনের শরণাপন্ন হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি।
এমতাবস্থায় তাদের প্রতিবেশীদের কাছে এর সত্যতা জানতে চাইলে তারা বলেন, গাঠি মোহাম্মদের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ছেলের সংসারেই খেয়ে-পড়ে থাকতেন তিনি। শুরুর দিকে ছেলের বউ ভালো আচরণ করলেও ধীরে ধীরে তার উপর অমানসিক নির্যাতন শুরু হয়। নির্যাতনের কারণ জানতে চাইলে প্রতিবেশীরা বলেন, গাঠি মোহাম্মদের বয়স অনেক হওয়ায় কোনো কাজ করতে সক্ষম ছিলেন না তিনি। আর এটাকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতেন তাঁর ছেলের বৌ। শ্বশুরকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্য প্রতিদিন নিজ স্বামীর কাছে অভিযোগ করতো গাঠি মোহাম্মদের ছেলের বৌ। শুরুর দিকে মাহির তার বৌয়ের সব অভিযোগ প্রত্যাখান করলেও আস্তে আস্তে নিজেও বাবার প্রতি অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন। কথায় কথায় নিজ বাবাকে নানা-কায়দায় কথা শোনাতো, বিভিন্নভাবে গালিগালাজ করতো, একইসাথে নির্যাতনও চালিয়ে যেত।
এক পর্যায়ে বৃদ্ধ বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন মাহির। রাজিবপুরের এই ঘটনা এখন বাংলাদেশে মহামারি আকার ধারণ করেছে। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানদের অবহেলা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। যার জন্য বয়স্ক বাবা-মায়েরা স্থান পাচ্ছে হয় বৃদ্ধাশ্রমে আর তা কপালে না জুটলে পথে-ঘাটে। অথচ এক’দু দশক আগেও আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম তেমন একটা ছিলনা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর সংখ্যা প্রতিনিয়ত উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কিন্তু কেন এই বৃদ্ধাশ্রম? কেনো এখনকার সন্তানদের বাবা-মায়ের প্রতি এমন বিরুদ্ধাচরণ? এ প্রশ্নের উত্তর বড়ই করুণ। যে সন্তান বাবা-মাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারতনা, মা-বাবাই ছিল যার সারাজীবনের আশ্রয়স্থল, সে কিনা আজ বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ করছে না, বাবা-মাকে ঝামেলা মনে করছেন। তাঁদেরকে রেখে আসছেন বৃদ্ধাশ্রমে। অথবা বাবা-মায়ের সাথে অবহেলা ও দুর্ব্যবহার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে যেন তারা নিজেরাই নিজের থেকে ভিন্ন কোনো ঠাঁই খুঁজে নেন।
অনেকের ভাব এমন, টাকা পয়সার অভাব না থাকলেও বাবা-মাকে দেওয়ার মত সময়ের তাদের অভাব আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলার মতো পর্যাপ্ত সময় তাদের নেই। তাই বাবা-মা একা নির্জনে থাকার চেয়ে বৃদ্ধাশ্রমে অন্যদের সঙ্গে কাটানোই নাকি সন্তানদের কাছে ভালো মনে হয়। এ ধরনের নানা অজুহাতে বাবা-মাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সরকার কি করবে জানিনা, কিন্তু ঠিক এক বছর আগে ভারতের আসাম রাজ্যে এমনই এক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, সরকারি কর্মচারীরা তাদের বাবা-মায়ের ঠিকমতো দেখাশোনা না করলে তাদের বেতন থেকে একটা অংশ কেটে নেওয়া হবে। যেই বেতনের অংশ দিয়ে রাজ্য সরকার নিজেরাই সেসব বাবা-মায়েদের ভরণপোষণের খরচ চালাবেন।