মোঃ তোফাজ্জল হায়দার: দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবার চিত্র বদলে গেছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত কয়েকজন চিকিৎসক বদলে দিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবার এই দৃশ্যপট। টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে তাদের একান্তিক প্রচেষ্টায় এই স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে এখন অনেক ভালো মানের চিকিৎসার সেবা প্রদান করা হচ্ছে। হচ্ছে নিরাপদে নরমাল ডেলিভারী ।
বেষ্ট ফিডিং কর্ণার চালুর মাধ্যমে স্বাস্থ্যকমপ্লেক শিশু বান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে নরমাল ডেরিভারীর মাধ্যমে সন্তান প্রসবের উদ্যোগ সফলতা লাভ করায় এটি মডেল হিসেবে জেলায় এখন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
চিকিৎসকগণের এই মহতি উদোগ্যেকে অভিনন্দন জানিয়ে সফলতা কামনা করে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের (চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ) সচিব মোঃ সিরাজুল ইসলাম বার্তা প্রদান করেছেন ।
উপজেলায় অলিগলিতে বেসরকারী হাসপাতাল আর ক্লিনিক হওয়ায় দালাল চক্রের কারণে নরমাল ডেলিভারী প্রায় বন্ধদের দিকে। এসব ক্লিনিক এবং হাসপাতালে সেবার পরিবর্তে শুরু হয়েছে প্রসুতি সিজারের নামে এক ধরণের ব্যবসা। আর অর্থের লোভে তাদের হয়ে কাজ করছে একটি দালাল চক্র। আবার গ্রামাঞ্চলে কিছু অদক্ষ, প্রশিক্ষনবিহিন ধাত্রী রয়েছে। যারা স্থানীয় ভাবে দাই মা বলে পরিচিত। এই দাই মার কারণে প্রসূতি মায়েদের মৃত্যু ঝুকি থাকে এবং মৃত্যুও ঘটে। এমন অনেক ঘটনার নজির রয়েছে এলাকায়। ক্লিনিকে প্রসুতি ও শিশু মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ ও সড়ক অবরোধের ঘটনাও ঘটেছে।
সিজারের নামে বানিজ্য, দালাল চক্র এবং অদক্ষ ধাত্রীর হাত থেকে প্রসুতি মায়েদের রক্ষায় এবং নিরাপদে নরমাল ডেলিভারী করাতেই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ জাহাঙ্গীর কবীরের নেতৃত্বে বীরগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েকজন চিকিৎসক টিম ওয়ার্ক শুরু করেন।
চলতি বছরের জানুয়ারী মাস থেকে টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন বীরগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকগণ। নরমাল ডেরিভারীর মাধ্যমে সন্তান প্রসব করতে প্রসুতিদের উদ্ধুদ্ধ করণ প্রচারনায় তারা বিভিন্ন কৌশলও কাজে লাগিয়েছেন। এজন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পক্ষ থেকে প্রসূতি মহিলাদের বিনামূল্যে ‘প্রসূতি কার্ড’ দেয়া হয়। এরপর ডেলিভারী না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে কাউন্সিলিং আর ফ্রি চেক আপ। প্রসূতি কার্ড ও নরমাল ডেলিভারী করাতে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষক, চেয়ারম্যান-মেম্বার, অন্যান্য জনপ্রতিনিধি, সরকার ও বিভিন্ন এনজিও’র স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে বার্তা পৌছানো হয়। এ ছাড়াও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরাও নিজেরা বিভিন্ন স্থানে গিয়েও কাউন্সিলিং প্রদান করেন।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এ টিম ওয়ার্কে রয়েছেন বীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ জাহাঙ্গীর কবীর, আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ মাহমুদুল হাসান পলাশ, মেডিকেল অফিসার ডাঃ আফরোজ সুলতানা, ডাঃ তাহমিনা ফেরদৌস, ডাঃ মাধবী দাস।
এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের বিগত আগস্ট মাসে ৩৫ জনকে নরমাল ডেলিভারী করানো হয়। আর গত সেপ্টেম্বর মাসের ৩৮ টি ও ৬ অক্টোবর পর্য়ন্ত ৮ টি নরমাল ডেলিভারী করানো হয়েছে। হাসপাতালে এসে নরমাল ডেলিভারী করানোর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই।
বীরগঞ্জের দামাইক্ষেত্র গ্রামের মোঃ আজিজার রহমানের স্ত্রী মোছাঃ জেসমিন আকতারের (৩৩) ৩ সন্তান রয়েছে। প্রথম সন্তান মেয়ে ১৩ বছর। দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে ৯ বছর। তৃতীয় সন্তান ছেলে ৬ বছর। শুক্রবার সকালে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নরমাল ডেলিভারীরের মাধ্যমে একটি ছেলে সন্তান জন্ম দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বেডে অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে মোছাঃ জেসমিন আকতার জানান, বয়সের কারণে এবং দেরি করে সন্তান নেওয়ায় এলাকার কিছু লোকের কথায় ভয় পেয়েছিলাম। অনেকে ক্লিনিকে সিজার করার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাঠ কর্মী এবং চিকিৎসকরা নির্ভয় প্রদান করে দায়িত্ব নিলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হই। এখানে স্বাভাবিক ভাবে (নরমাল ডেলিভারী) একটি ছেলে সন্তান জন্ম লাভ করে। আমি এবং আমার ছেলে এখন সুস্থ্য আছে। কোন সমস্যা অনুভব করছি না। প্রথমে ভয় পেলেও এখন আমি খুশি। একই কথা বললেন বীরগঞ্জের ভোগনগর গ্রামের মোঃ নিশাদ ইসলামের স্ত্রী মোছাঃ শাপলা বেগম (২১), দেবীপুর গ্রামের মোঃ মিলন ইসলামের স্ত্রী মোছাঃ ফাতিমা বেগম (২৬)। শনিবার এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩ জনের নরমাল ডেলিভারী হয়েছে।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ মাহমুদুল হাসান পলাশ জানান, এক সময় বীরগঞ্জ হাসপাতালে প্রসূতিরা না আসায় নরমাল ডেলিভারী করানো প্রায়ই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চলতি বছরের জানুয়ারী মাস থেকে আমরা সবাই মিলে টিম ওয়ার্ক শুরু করি। দালাল চক্রের কিংবা দাইমা (ধাত্রী)দের বাধা উপেক্ষা করে এর সফলতা পেয়েছি। উদ্যোগ গ্রহণের পর জানুয়ারী মাসে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫/৬টি নরমাল করা হয়েছে। পরে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে বিগত আগস্ট মাসে ৩৫ জন নরমাল ডেলিভারী করানো হয়। আর এ গত সেপ্টেম্বর মাসের তারিখ পর্যন্ত ৩৮ টি নরমাল ডেলিভারী করানো হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ জাহাঙ্গীর কবীর জানান, এ হাসপাতালে ডেলিভারী নিরাপদ করতে ৫জন দক্ষ মিডওয়েফ রয়েছেন। ডেলিভারী হওয়ার পর উপজেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় জন্ম নেয়া শিশুর জন্য জামা-কাপড় এবং মশারী ওই শিশুর মাকে উপহার দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দিন দিন নরমাল ডেলিভারী ক্ষেত্রে প্রসুতিদের আগ্রহ বাড়ছে। কারণ হাসপাতালে নিরাপদে এ ডেলিভারী করানো হলে মৃত্যুর ঝুকি থাকে না। এভাবে নরমাল ডেলিভারী হলে মানুষের অর্থ সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত ও নিরাপদ হবে।