উদ্যোক্তা ডেস্কঃ
আমি প্রভাত। আজ আমি আমাকে নিয়ে কিছু কথা বলব। সময় হলে দয়া করে পড়বেন। যাই হোক,জানি না আমি কতটা সফল হতে পেরেছি তবে যখন ছোট ছিলাম তখন বাবা বলত আমার ছেলে UNO বা Magistrate হবে। সত্যি বলতে আমি অতটা মেধাবী ছাত্র না। স্কুল জীবন এ কখনও ভালো ফলাফল আমি আমার বাবার হাতে তুলে দিতে পারি নাই। ”খ” শাখার শেষের ব্রেঞ্চ এর ছাত্র আমি। আমার ইচ্ছা ছিল কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। জানি না কতটুকু সত্যিকারের ইঞ্জিনিয়ার হতে পেরেছি। হয়তবা কাগজের সনদ আমার তুলনামুলক কম, বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার এর চেয়ে। হয়ত আমি ইঞ্জিনিয়ার না এই বিভাগের কিছু কাজ করতে পারি যা আমার ছোট বেলার স্বপ্ন।
এখন ও মনে পড়ে মায়ের কত যে বকা খেয়েছি নতুন বিছানার চাঁদর ব্যাটারির এসিডে নষ্ট করে। বাবার হাতের চার্জার (টর্চ ) লাইট কতবার খুলে যে নষ্ট করেছি তার তো হিসাবই নাই। কতবার যে আমাদের টিভি নষ্ট করেছি আর ভয়ে লুকিয়ে ছিলাম। আর টিভির মেকার আসলে স্থির রোবট হয়ে দেখেছি কিভাবে ভালো করে। বাবার কাছে দুই দিন কান্না করে একটা ভিডিও গেম (ডেস্কটপ ভার্সন) নিয়েছিলাম ৩৮০ টাকা দিয়ে যখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। ব্যাটারি প্রতিদিন ই শেষ হয়ে যেত তাই চার্জার লাইট এর ব্যাটারি থেকে পাওয়ার নিয়ে চালানোর চেষ্টা করতে গিয়েই তিন দিনের মাথায় সব শেষ। সবাই টাকা জমিয়ে কতকিছুই না কিনে আর আমি Electric soldering iron/ Switch/ Speaker/LED Bulb কিনতাম।
বিভিন্ন সেলুন এ দেখতাম শীতের দিনে এক মগ পানিতে দুইটা ব্লেড ডুবিয়ে দিয়ে তাতে ইলেকট্রিক লাইন দিলে কিছুক্ষন পর সেই মগের পানি গরম হয় আর তা ব্যবহার করা হতো সেভের কাজে। সেই পদ্ধতি দেখে মাটির পাত্রে পানি রেখে তাতে আমিও পরীক্ষা চালিয়েছিলাম আর অবাক হয়ে দেখতেছিলাম যে কেমন বুদ বুদ করে যেন পানি থেকে একটা ধোয়া বের হতো যেই না মাটির পাত্রে হাত দিয়ে দেখতে গেছি অমনি ২২০ ভোল্ট এর একটা ধাক্কা !
সেদিন বুঝতে পেরেছি যে কারেন্ট কি জিনিস তার পরও নেশা ছাড়িনি। আমার বড় ভাই বাড়িতে নিজেদের ঘড়ের ইলেকট্রিক লাইন ওয়্যারিং করত আর আমি দাড়িয়ে দেখতে দেখতে ঘাড়ের ব্যাথা ধরে যেত তার পর আমার ঘড়ের সুইচ বোর্ড এ প্রথমবার (Integrator Light) সেট করে ফেলেছিলাম। কত ঘন্টার পড় ঘন্টা মানুষের দোকানে কম্পিউটার দিয়ে ক্যামন করে কাজ করে সেটা দেখার জন্য দাড়িয়ে ছিলাম তা বলে বুঝানোর মত না । টিফিন এর সময় সবাই বাড়িতে যেত আর আমি বিভিন্ন স্টুডিও তে বসে বসে কম্পিউটার দিয়ে ক্যামন করে ছবিতে কাজ করে সেটা দেখতাম।
অনেক এর মোবাইল ও আমার হাতে নষ্ট হয়েছিল তার জন্য কম বকা খাইনি! অবশ্য অনেকে আবার মোবাইল এর কোন সমস্যা হলে (Operating System) এর জন্য শিখতে হলেও আমার কাছে আসত। কত জনের মোবাইল এর মেমরি কার্ড নিয়ে গেছিলাম গান ডাউনলোড করার জন্য, উদ্দেশ্য একটাই কিভাবে মেমরি কার্ডে গান লোড দেয় সেটা দেখার জন্য। আমার প্রিয় বিদ্যালয় (ফুলবাড়ী জছিমিঞা মডেল উচ্চ বিদ্যালয়) এর কম্পিউটার এ একদিন হিন্দি গান সংরক্ষন করে রেখেছিলাম ওরে বাবা তার জন্য শ্রদ্ধেয় (আকতারা ম্যাডাম ) সবার সামনে যা বলেছিল তা আজও আমার মনে স্বর্নাক্ষরে লেখা আছে। কত যে ঘড়ের বাল্ব আর সার্কিট ব্রেকার নষ্ট হয়েছে আমার জন্য তা বলার মত না।
অবাক হবেন না! আমার ‘মা’ একদিন তো আমার কারনে বৈদ্যুতিক শক খেয়ে মৃত প্রায় অবস্থা । সবার বাড়িতে দেখতাম টিভি চালু করলে একটা বাল্ব খুবই সামান্য পরিমান করে জ্বলত আর আমাদের টিভিতে এ ধরনের কোন ব্যবস্থা নেই এক ভাইকে বললাম এটা ক্যামনে হয়? ভাই বলল এটাকে সিরিজ লাইন বলে, উচ্চ ভোল্টেজ থেকে টিভিকে রক্ষা করে। তারপর আর কি করার অবশেষে বিভিন্ন উপায় বের করে টাকা জমিয়ে সবকিছু ঠিক কিন্তু আমার টিভিতে অর্ধেক পর্দা আসে মনেহয় ব্যাটারিতে চার্জ নাই কিন্তু সেটা তো বৈদ্যুতিক লাইন এমনটা তো হবার নয়! হবেই না বা কেন আমি যে বাল্ব ৪০ ওয়াট এর লাগিয়েছি!
আমি খুব দুষ্ট ছিলাম শুধু মাত্র এই সব বিষয়ে । অন্য কোন বিষয়ে আমার তেমন কোন আগ্রহই ছিল না। বাবা মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে আমাকে ধাওয়া করত আর আমি পালিয়ে বেড়াইতাম। আপনি বলেন তো রাগ করাটা কি স্বাভাবিক নয়? নতুন লাইট, বাল্ব, বিছানার চাঁদর যদি আমার কারনে নষ্ট হয় তাহলে কোন বাবার মেজাজ ঠিক থাকবে ? যাই হোক এবার বাবার কঠিন নির্দেশ বাবা যতক্ষন না বাজার থেকে বাড়িতে আসবে ততক্ষন আমার রাত্রের খাওয়া বন্ধ শুধু বই পড়তে হবে, বাবা আসত চুপি চুপি করে বুঝতেও পারতাম না যে বাবা কখন আসছে আর তখন বাবা ইচ্ছা করে অনেক রাত করে বাড়িতে আসত। আবার ভোরের সময় উঠে পড়তে বসা আমার কাছে যে কি বিরক্তিকর ছিল তা বোঝাতে পারব না। যাই হোক বাবার প্রচেষ্টার ফলে S,S,C পরিক্ষায় সফলভাবে কিছুটা তার মন মত ফলাফল নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। তখন বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন। তার খুব ইচ্ছা ছিল আমি সরকারি কোন পলিটেকনিক থেকে পড়াশুনা করি কিন্তু আমার তো সেই কপাল ও মেধা নাই! দুইবার চেষ্টা করার পড়েও কোন সরকারী পলিটেকনিক এ কোন যায়গা করে নিতে পারি নাই। এতে বাবা কোন রাগ করে নাই। আমি পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতাম আর খুজতাম ল্যাব/মেশিন কোন রুমে। পরিক্ষা শেষ করে আমি ঘুরতার আর খুজতাম মেশিন রুম কোথায়, কম্পিউটার ল্যাব কোথায়? অবশেষে বেসরকারী পলিটেকনিক (ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি, রংপুর (আই,ই,টি) তে শুরু করলাম স্বপ্ন যাত্রা ।
কত যে ম্যাডামের বকা শুনেছি ক্লাস ফাকি দেওয়ার জন্য। ক্লাসের সবচেয়ে অমনযোগি ছাত্র আমি। ২য় পর্ব তে উঠেই বাবার কাছে জোর করে কম্পিউটার কিনে নেই আর তার পড়ের দিনই Power Supply নষ্ট করি! হাসি পাচ্ছে তাই না? আমি রাত্রে নতুন ডেস্কটপ নিয়ে মেসে আসলাম আর সারা রাত্রি তো কোন ঘুম নাই সেই ভোর বেলা উঠে কম্পিউটার অন করে বসেছি তা হঠাৎ দেখি পাওয়ার সাপ্লাই এর গায়ে এক সুইচ (120-220) ভোল্ট লেখা আমি 220 ভোল্ট থেকে 120 ভোল্ট এ সুইচ দিয়ে যেই কম্পিউটার সুইচ দিয়েছি তাতেই কাজ হয়ে গেছে। ঘর তো এবার ধোয়াতে ভর্তি, মেসের সবাই অবাক!
খুলে দেখলাম একটা ফিউজ পুরে গেছে সবাই বল্ল নতুন পাওয়ার সাপ্লাই কিনে লাগাতে হবে কি আর করার কত মিথ্যা কথা বলে যে বাবার থেকে টাকা নিয়ে কত কি কিনেছি সেটা বলতে পারব না।
Windows-XP/ Windows-7 / Microsoft Office 2003,2007, Bijoy , Bangla Fornt কিভাবে Install করব তা শিখতে গিয়ে কতজন কে যে কত কি খাওয়াইতে হয়েছে তার বিনিময়ে তা বলার বাহিরে। ইন্টারনেট শিখতে 2011তে CityCell মডেম কিনেছিলাম বাবার কাছে জোর করে টাকা নিয়ে আর এই মডেম কিভাবে ইন্সটল দিতে হবে এবং কিভাবে কাজ করে সেটা জানতে কতজনের মেসে মেসে মডেম নিয়ে যে ঘুড়ে বেড়াইতাম তা বুঝাব ক্যামনে? ৩৫০ টাকায় ১ জিবি ইন্টারনেট একদিনেই শেষ করা মানুষ আমি আর বাকি ২৯ দিন ইন্টারনেট ছাড়া কাটাই।
বই খুলে পড়তে বসেও আমার কম্পিউটার চালু থাকে! বিভিন্ন যায়গায় দেখতাম কম্পিউটার এর পিছনে একটা সাদা ক্যাবল লাগানো থাকত বুঝতে পারতাম না এটা কি জিনিস? অনেকের কম্পিউটার এ দেখতাম ইন্টারনেট ও চলে মডেম ছাড়া মাথা আর কাজ করে না। কবে এসব শেখাবে কলেজে? ষষ্ঠ পর্ব এক স্যার দুই তিন হাত ল্যান ক্যাবল এনে একদিন সবাইকে দেখালে কেমনে ল্যান ক্যাবল দিয়ে দুইটা কম্পিউটার সংযোগ করা যায় কি ভাবে একটা কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটার এর সকল কাজ করা যায়, ফাইল আদান-প্রদান করা যায়। ভূত চেপে বসেছে ঢাকা থেকে বড় দাদা কে বলে LAN Cable আনিয়ে দুইটা কম্পিউটার এ প্রথম Networking করেছিলাম।
৬ষ্ঠ পর্বে আমি ছোট্ট একটা সফট্ওয়ার তৈরি করেছিলাম আমার বিভাগের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের ডাটাবেজ, মনেহয় তখন স্যার/ম্যাডামরা একটু ভালো চোখে দেখতে শুরু করেছে বুঝতে পেরেছিলাম। শুনে অবাক হবেন আমার শেষ পর্বের পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই আমার চাকুরী হয়েছে। ১০ দিন চাকুরী বয়সে আমি ছুটি নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। আমার সকল বন্ধু বান্ধবিরা তো আবার প্রভাত চাকুরী করে তাও আবার পরীক্ষা শেষ না হতেই, ফলাফল হাতে না পেয়েই। যাই হোক অবশেষে নির্ধারিত সময়ে (৪ বছর) পর আমি একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এর মেডেল পাইলাম।
আজ ৪ বছর ধরে আছি একটা গার্মেন্টস কোম্পানিতে, IT-Officer পদে। অনেকে হয়ত ঠাট্টা করে, কেউ কেউ বলে ইঞ্জিনিয়ারিং করে গার্মেন্টস এ চাকুরী এ আবার কেমন? কেউ বলে গার্মেন্টস কর্মী ইত্যাদি। অনেকেই আবার অনেক আগ্রহ নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে শুরু করে যখন শুনতে পায় আমি গার্মেন্টস কোম্পানিতে চাকুরী করি তখন আর সেই আগ্রহ টা থাকে না। প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ হত। অবশ্য এখন আর হয় না। অনেকেই বলে আমি কোন Software কোম্পানিতে কি কাজ করতে পারি না? আমি বলি কি দরকার অতটা যোগ্যতা আমার নেই ভাই। আমি ছোট মানুষ ছোট কাজ করি। আজ আমার এই যায়গায় আসা হয়ত হইত না যদি বাবা/মা চাইত আমি UNO বা Magistrate হই। তারা যদি আজ আমার স্বপ্ন পূরণের কারিগর না হইত তাহলে হয়ত বা এই প্রভাত আজকে আপনাদের সামনে তেমন কোন পরিচয় দিতে পারত না তেমন কেউ হয়ত বা চিনত না, বাবা হয়ত চিন্তা করত কবে আমার ছেলে একটা চাকুরী করবে। বড় কোন যায়গায় হয়ত যায়গা করে নিতে পারি নাই তবে মনে করি আমার প্রাপ্য যায়গাটা আমি পেয়েছি।
আজ একটা কোম্পানি আমার দ্বায়িত্বে সম্পুর্ন সিস্টেম। আমি নিজেই দেখা-শোনা করি আমার স্যার রা মাঝে মাঝে বলে তাদের কম্পিউটার এ অনেক সমস্যা থাকে আর যেই আমি না কি তাদের কম্পিউটার এর কাছে যাই তখন সব ঠিকঠাক কাজ করে।
আজ এ কথাগুলা বলার একটাই কারন। আমি প্রতিটা বাবা/মা কে বলব আপনারা আপনাদের সন্তানকে আপনার স্বপ্নে নয় তার নিজের স্বপ্ন জয়ের জন্য উৎসাহিত করুন। তাদের স্বপ্নের কথা শুনুন দেখুন। সে সবথেকে কোন দিকে বেশি ভালো করতে পারে তাকে সেই দিকেই উৎসাহিত করুন। দেখবেন একদিন সে নিশ্চই তার স্বপ্ন জয় করে আপনার বুকে ফিরে আসবে।
সেদিন আপনার থেকে খুশি হয়তবা আর কেউ হবে না। আমি বার বার প্রতিটা বাবা/মা কে বলব দয়া করে ওদের স্বপ্নগুলা নষ্ট করিয়েন না। আপনিই হলেন আপনার সন্তানের স্বপ্ন গড়ার কারিগর। আর আজ আমার এই সাফল্য আমার বাবার জন্য বাবা যদি তার স্বপ্ন ত্যাগ না করত তাহলে হয়ত আমি এতকিছু বলতে পারতাম না।
লেখাঃ
প্রভাত সেন।
আইটি অফিসার ফ্যাশন স্টোর লিঃ