থেমে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা,কিন্তু ভেঙে দিয়ে গেছে বাংলার সমাজ জীবন কাঠামো। থেমে গেছে হাজার হাজার মানুষের জীবন রথের চাকা। গ্রাম্য সরল,নিরক্ষর মানুষগুলো শোষন নীতির চাপে হয়ে গেছে পঙ্গু,স্বাস্থ্যহীন,শ্রীহিন।
মধুমতির পরিবার ও ছিল সেই গ্রাম্য মানুষগুলোর দলে।দুদিন থেকে চুলোয় হাড়ি উঠেনি,মধুমতি তখন তিন সন্তানের জননী।তার স্বামী ছিলেন একজন গ্রাম্য কৃষক।একে তো দেশের বেহাল অবস্থা তার উপর চৈত্র মাস। ধু ধু মাঠ,বৃষ্টি অভাবে মাঠ ঘাট ফেটে চৌচির।থেমে গেছে কৃষকের উপার্যনের পথ। গ্রাম কৃষকদের জীবনে নেমে এসেছে চরম দূর্ভোগ। একদিকে পরিবারের লোকসংখ্যা বাড়ছে,অপর দিকে থেমে যাচ্ছে উপার্জনের পথ। আগে তো দু মুঠো ভাত জুটতো কপালে,এখন তাও বন্ধ প্রায়। একদিন বিকেলে কৃষক বাড়ি ফিরলেন মলিন মুখে। দাওয়ায় বসে আকাশ পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কি যেন ভাবলেন একমনে।
তারপর মধুমতিকে ডেকে বললেন ‘বৌ’
তোমাকে দুবেলা দুমুঠো ভাত ছাড়া তোর কিছুই দিতে পারিনি,এখন তাও বন্ধ প্রায়,বাচ্চাগুলোর দিকে তাকানো যায় না,এবার না খেতে পেয়ে মরতে হবে। কেন যে আমাকে বিয়ে করতে গেলে।
মধুমতি ছিল বীপরিত প্রকৃতির মেয়ে,সেই সময়ে শত বাধা প্রতিকুলতার সাথে লড়াই করে কলেজ অঙ্গনে পদার্পন করেছিল,
উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছিল। কিন্তু এক গ্রাম কৃষককে ভালোবেসে ফেলে আর তাকে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করে। তবুও সে থেমে থাকে নি কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা মিলে কৃষকের ন্যায্য পাওনা দিতে করেছিল তেভাগা আন্দোলন।
-কৃষকের মলিন মুখের দিকে চেয়ে মধুমতি বলে আমি জমিদারের কাছে গেলে তোমাকে ঠিক একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেবে।
-কিন্তু কৃষক তাকে বাধা দিয়ে বলে না থাক লোকটার নজর খারাপ,তোমার ওপর কুদৃষ্টি পড়বে,জীবন যাক কিন্তু শেষ সম্মানটুকু বেঁচে থাক।
স্বামী সন্তানকে বাঁচাতে আর উপায় না পেয়ে মধুমতি তার বাবার বন্ধুর সাহায্যে চাকুরি নেয় রেলস্টেশনে ত্রিশ টাকা বেতন। সংসারের মায়া ত্যাগ করে পরিবার পরিজনের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে বেরিয়ে পরে মধুমতি। কয়মাস ভালোই কাটে ত্রিশ টাকা থেকে নিজের জন্য চার টাকা রেখে ছাব্বিশ টাকা স্বামীর কাছে পাঠয়। কিন্তু দেশে দেখা দেয় প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ। বেতনের পুরো টাকাটা পাঠালেও আর স্বামী সন্তানদের রক্ষা করতে পারবে না মধুমতি।
এরই মধ্যে তার স্বামীর চিঠি আসে..
-বাচ্চারা তোমার জন্য খুব ছটফট করছে,কতদিন তোমাকে দিখিনি,তুমি চলে এসো ।বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে তোমায়।
চিঠিটা ডাকে দেবার সতের দিন পর মধুমতি চিঠিটা পায়। সাথে সাথে ট্রেনে উঠে রওনা দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে, মধুমতি ফিরে এসেছে তার চিরচেনা গ্রামে,ভালোবাসার টানে,স্বপ্নের সন্ধ্যানে।
জমিদার বাড়ির সামনে এসে থমকে গেছে তার পথ।চিরচেনা গ্রাম আজ ধু ধু মরুভূমি।কোথাও চিহ্ন নেই কোন মানুষের।দুর্ভিক্ষে রহিত হয়েছে পুরুষের জীবনীশক্তি,নারীরা নিঃশেষিত হয়েছে মাতৃদুদ্ধ হতে।শিশুরা বাঁচার জন্য শুকনো মাতৃবক্ষে স্থাপন করেছিল তাদের ক্ষুধার্ত ওষ্ঠ,চুম্বক চুম্বনে আহরন করতে চেয়েছিল মাতৃদুগ্ধ। কিন্তু পরিবর্তে বেরিয়ে এসেছিলো দু এক ফোঁটা জীবন নিংড়ানো রক্ত। সন্তানের ক্ষুধার মুখে মায়েরা এমনি করে গিয়েছিল মরে।
কোথাও কোন মৃতদেহ পড়েছিলো না,মানুষ ক্ষুধার তারনায় ভক্ষন করেছিল মৃত মানুষের রক্ত।
তার স্বামী সন্তানদের খুজতে গিয়ে মধুমতি পায় না কোথাও কোন মানবের চিহ্ন। হৃদপিন্ড ফেটে তার আত্মচিৎকার ছড়িয়ে পরেছিলো বাংলা আকাশে।
মধুমতি যখন ফিরে আসে তার চাকুরিস্থলে,চাচা বলে তোর চাকুরি আর নেই।
মধুমতি বলে আমি চাকুরি করতে আসিনি, এসেছি আমার কৃষকের দেওয়া সাদা শাড়িটি নিতে যেটা সে আমাকে নামাজ পড়ার জন্য দিয়েছিল।
সেই সাদা শাড়ি পরে মধুমতি হাটছে,হাটতে হাটতে তার পা দুটো প্রায় অচল,আর ক্ষমতা নেই এক পা এগুনোর।
তাই ধু ধু মরুভূমিময় পথের ধারে মধুমতি বসে পরে। জীবনের হিসাব নিকাশ করতে বসে চোখে ভাসে তার নারিছেড়া ধনদের মুখচ্ছবি,কৃষকের ভালোবাসা। মৃত্যুকালে হয়তোবা একফোটা পানিও জোটেনি মুখে,ক্ষুধার তারনায় করেছিলো কতো আকুতি,এসব কথা ভাবতে থাকে মধুমতি,আর তার দুচোখে বেয়ে গড়িয়ে পরে অশ্রু,এই অশ্রু বইতে থাকে ততদিন অবধি যতদিন তার প্রাণ ছিলো,অশ্রুর সাথে রক্তফোটা একত্রিত হয়ে সমাপ্তি ঘটে মধুমতির গল্পের।কিন্তু ততোদিনে সেই অশ্রু বেয়ে বেয়ে পথের ধারে একটা নদী তৈরি হয়ে গিয়েছিলো।
গ্রামের মানুষ মধুমতির স্মরণে ঐ নদীর নাম দিয়েছিলেন মধুমতি। আজও ঐ মধুমতি নদীর স্রোতে ভেসে বেরায় মধুমতির চোখের জল,মধুমতির জলের প্রত্যেকটি ফোঁটা আজো খুজে মধুমতির হারানো সন্তান ও তার কৃষক স্বামীকে।খুজতে খুজতে সাগর অবধি পৌছায় মধুমতির জল কিন্তু কোথাও কোন চিহ্ন মেলে না তাদের।
লিখেছেনঃ জলস্পোর্শী তটিনী