আজ ৩১ জানুয়ারি ‘২০২৫ কমরেড শান্তি সেনের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৯১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুর জেলার রামভদ্রপুর গ্রামে কমরেড শান্তি সেন জন্মগ্রহণ করেন। মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার চেয়ে বাহিরের জ্ঞানান্বেষণেই ঝোঁক ছিল অধিক। খেলা ধুলা, বীরত্বপূর্ণ কাজ ও দুরন্তপনায় আকর্ষণ ছিল বেশি। বাবা ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। বাঙালি আর ভারতীয় কর্মচারী ও জনগণের প্রতি ইংরেজদের তাচ্ছিল্যপূর্ণ দুর্ব্যবহার কাছ থেকে দেখে বাল্যকালেই তাঁর মধ্যে ব্রিটিশ বিদ্বেষ জন্ম নেয়। এই মনোভাবই তার মধ্যে প্রচন্ড দেশপ্রেম জাগ্রত করে এবং ভারতকে স্বাধীন করার সংকল্প দৃঢ় হতে থাকে। ক্ষুদিরাম, কানাইলাল প্রমূখ বিপ্লবী এবং সিপাহী বিদ্রোহ ও তিতুমীরের কাহিনীসহ দেশব্যাপী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে তিনি উদ্বুদ্ধ হন। দুরন্ত আর দুঃসাহসী শান্তি সেন বিপ্লবী দলে যোগদানের জন্য শরীর চর্চা, লাঠি খেলা, ছোরা ও তরবারি চালানো, মুষ্টিযুদ্ধ ও কারাতে নিজেকে পারদর্শী করে তোলেন। ১৯২৯ সালে বিপ্লবী দল যুগান্তরে যোগদান করেন। ১৯৩০ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাভোগ করেন। গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে দেশ ও জনগণের মুক্তি আসবেনা এটা তিনি অনুধাবন করেন। দরিদ্রদের উপর ধনীদের অমানুষিক অত্যাচার ও নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ব্যবহার এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি তাঁকে আরো বিদ্রোহী করে তোলে। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার ঘটনা তাঁর মত অনেককেই কমিউনিস্ট পার্টি, রুশ বিপ্লব ও সাম্যবাদের আদর্শ-উদ্দেশ্য এবং শোষনমুক্ত সমাজের নতুন দিশা জানার সুযোগ করে দেয়। তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হওয়ার পথ খুঁজতে শুরু করেন। তখন যুগান্তর ও অনুশীলন ছিল কঠোর কমিউনিস্ট বিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন। যুগান্তর দলের নেতারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ও কর্মকৌশল জানার আগ্রহের কথা জানতে পেরে নানারকম কুটচালে ওনাকে দলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে আটকিয়ে রাখে। যদিও কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে তাঁর জানা বুঝা ছিল খুবই প্রাথমিক। কঠোর গোপনীয়তার কারণে কমিউনিস্ট নেতা কর্মীর সাথে তাদের যোগাযোগও ছিল না। ১৯৩৫ সালে ১ জানুয়ারি আবার গ্রেফতার হন। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য একটানা ১৫ দিন জেলখানায় অমানুষিক দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের পর আলীপুর কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। আলীপুর স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে ইংরেজ সম্রাটের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের অভিযোগে ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয় এবং ২ বছর লোহার খাঁচায় বন্দী থাকতে হয়। জেলখানার নানারকম নিষ্ঠুর নির্যাতন, পশুর খাওয়ার অনুপযোগী খাদ্য কয়েদীদের খাওয়ানো, সারাক্ষণ ডাণ্ডা বেরী পড়িয়ে রাখা ইত্যাদির অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৯৩৭ সালে আন্দামান সহ সারা বাংলার বন্দীদের সাথে তিনি অনশনে অংশগ্রহণ করেন। এর আগেও তিনি কয়েকবার জেল আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। জেলখানাতেই কমিউনিস্ট পার্টি কমরেডদের সাথে পরিচয় হয় এবং প্রাথমিক দীক্ষা লাভ করেন। ৭ বছর কারাভোগের পর ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি পান।
ছাড়া পেয়ে তিনি কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হন এবং কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভ করেন। ঐ সময় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি বৈধ সংগঠন ছিল। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে ফরিদপুরে কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতী সমিতি, বিড়ি-রিক্সা শ্রমিক ও মেথর ইউনিয়ন এবং ছাত্র ফেডারেশন বেশ শক্তিশালী হয়েছিল।

পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই কমিউনিস্টদের উপর নেমে আসে বহুমাত্রিক আক্রমণ। জেল-জুলুম নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে তাদের উপর। একদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অন্যদিকে ভারতীয় চর বলে কমিউনিস্ট নিধন শুরু হয়। এসময় শান্তি সেন আত্মগোপনে চলে যান। পাকিস্তান সরকার তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এবং তাঁর স্ত্রী মাদারীপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকার চাকুরী থেকে বরখাস্ত করে। তাঁর স্ত্রী কমরেড অরুণা সেন ছিলেন পালং রাজপরিবারের মেয়ে এবং পার্টি কর্মী। ১৯৪৭ সালে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এসময় অরুণা সেন শিশু পুত্র চঞ্চল সেনকে নিয়ে চরম সংকটে পড়েন। তার উপর চলে শান্তি সেনের খরব জানার জন্য সরকারের নানারকম মানসিক নির্যাতন। পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পরে জেলেও যেতে হয় অরুণা সেন, ছন্দা সেনকে। অবশ্য তাতে কোন কথা বা তথ্য আদায় করতে পারেনি। পুরো পাকিস্তান আমল জুড়েই হয় জেলে নয়তো আত্মগোপনে কেটেছে অন্য কমিউনিস্টদের মত শান্তি সেনেরও।

সর্বশেষ ১৯৬৫ সালে দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান।
দেশ স্বাধীনের পর শেখ মুজিবের স্বৈরশাসনের বলি ও নির্মম -নিষ্ঠুরতম অত্যাচারের শিকার হন এদেশের হাজার হাজার কমিউনিস্ট নেতাকর্মী। সেই অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন শান্তি সেনের পরিবার। তাঁকে ধরতে না পেরে অরুণা সেন, পুত্র চঞ্চল সেন এবং ছন্দা সেন (পরে চঞ্চল সেনের স্ত্রী)এর উপর নেমে আসে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম নির্যাতন। এযাবৎ আবিস্কৃত নির্যাতনের সবরকম পদ্ধতিই তাদের উপর প্রয়োগ করা হয়। সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেও মানসিক যন্ত্রণা বাদেই শারীরিক যন্ত্রণা আজও ভোগ করে চলেছেন চঞ্চল সেন ও ছন্দা সেন। অরুণা সেন মারা যেয়ে মুক্তি পেয়েছেন। এসময় শত শত কমিউনিস্ট নেতাকর্মীকে হত্যা করে আওয়ামী লীগ। এতসব দমন-পীড়ন, জেল-জুলুম, অত্যাচার শান্তি সেনকে তাঁর আদর্শ ও সংগ্রাম থেকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। চরম আর্থিক অভাব-অনটন ছিল নিত্য সঙ্গী। সব ঝড়ঝাপটা উপেক্ষা করে তিনি আমৃত্যু বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছেন শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন কমিউনিস্ট পার্টির লাল পতাকা। তিনি নৌকা, ঘর বানান থেকে সমস্তরকম গৃহস্থালির কাজ জানতেন ও করতেন। তিনি নিজ গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি গ্রামের লোকের চিকিৎসা সেবাও দিতেন। ৩১ জানুয়ারি ১৯৮৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *