জলস্পর্শী তটিনীঃ
দীর্ঘ একমাস ত্যাগ তিতিক্ষা আত্মসংযমের পরে,খুশির বার্তা নিয়ে শাওয়ালের চাঁদ উকি দিচ্ছে সকল মুসলমানের ঘরে ঘরে।
খুশির বার্তা নিয়ে গগনে নতুন চাঁদ হাঁসে। আর তার ঝোলায় করে নিয়ে আসে আনন্দ। আমারা প্রত্যেকে হিংসা বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হই। যে কাউকে ঈদের স্মৃতিচারন করতে বলা হলে প্রত্যেকের মনে অপকটে ভেসে আসবে শৈশবের ঈদের কথা। হৃদয়ের কোণে ভেসে ওঠা আমার শৈশবের ঈদের স্মৃতিগুলো আধো আধো শব্দে এলোমেলো বাক্যে কালির আচড়ে ফুটিতে তুলতে যাচ্চি।
আমারা ছিলাম একান্নবর্তী পরিবারে। তাই বাড়ি ভর্তি পরিবারের সদস্য নিয়ে উৎযাপিত হতো ঈদের উৎসব। ঈদের দুই দিন আগে থেকেই মেহেদি গাছ থেকে পাতা তুলে বড় বোনেরা হাত রাঙাতে ব্যস্ত থাকতো। তাদের দলে আমরা ছোটরাও যোগ দিতাম মহা উৎসাহে। মেহেদি পড়া শেষে শুরু হতো চাঁদ দেখার পালা। উত্তরের বড় মাঠে গ্রামের সকল ছেলেমেয়ে মিলিত হতাম চাঁদ দেখবো বলে। কে আগে চাঁদ দেখবে এবং কে প্রথমে নতুন চাঁদকে সালাম দিবে এ নিয়ে চলতো প্রতিযোগিতা। চাঁদ দেখে ঘরে ফিরেই শুরু হতো নতুন বায়না। বাবা খুব ভালো গান গাইতে পারতেন। তাই সকলে মিলে বাবার কাছে বায়না ধরতাম,নজরুলের সেই জনপ্রিয় গানটি শোনার জন্য “রমজানের রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”।
বাবাকে আঙিনার মাঝে বসিয়ে গোল হয়ে বসতাম আমরা সবাই। বাবার মিষ্টি কন্ঠে সারাবাড়ি মেতে উঠতো। মা চাচিরাও কাজ ফেলে রান্নাঘরের দরজায় দাড়াতেন গানটি শুনার জন্য। বাবার গান শেষে বাবার কোলে ঝাপিয়ে পড়ে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে দিতাম ভো দৌড় ।কেনন গ্রামের বড় ভাইবোনেরা মিলে ঈদ উপলক্ষে আয়জন করেছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। গ্রামের ছোট বড় ছেলে মেয়ে সকলে মিলে উপভোগ করতাম সেই অনুষ্ঠান। হাসি তামাসা মিলে অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে অর্ধেক রাত কেঁটে যেতো। ঈদের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সেমাই ফিরনি খেয়ে ,হাতে পটকা নিয়ে ছুটে যেতাম আনন্দ মিছিল করতে। মিছিল শেষে শুরু হতো বড়দের আয়োজনে খেলাধুলা। প্রথম পুরস্কার পাবার জন্য সবথেকে কাছের বন্ধুটিও হয়েযেত চির প্রতিদ্বন্দ্বি। খেলাধুলো শেষে গোশল করে নতুন জামা কাপড় পরে আতর লাগিয়ে বাবার সাথে ঈদ গায়ে যাওয়ার পালা এবার। তার আগে পরিবারের সকল সদস্যকে সালাম দিয়ে সালামি নেওয়ার বেলাতেও ছিলো আলাদা আনন্দ। যেহেতু আমি মেয়ে ঈদ গায়ের এক কোনে দাড়িয়ে রেখে বাবারা সালাত আদায় করতেন। তারা যখন আল্লাহু আকবার ধনী নিয়ে সিজদায় যেতেন আমরা গুটি কয়েক মেয়ে একত্রিত হয়ে বলতাম দেখ দেখ কতগুলো রঙবেরঙের বালিশ।দুই,তিন,সাত,দশ করে করে বৃথাই গুনতে চেষ্টা করতাম মানুষগুলো।কতই না আনন্দঘন ছিলো মুহুর্তগুলো।
আজ যখন নিজের শৈশবের কথা ভাবতে বসি,উদাস কন্ঠে বাবা বলেন আমাদের ছোটবেলার ঈদ ছিলো অন্যরকম,শুধু ধনবান পরিবারে রান্না হতো সেমাই। আর আমাদের মা তো বড় পাতিলে সেদ্ধচালে গুড় আর দুধ পানি একত্রিত করে ক্ষীর রান্না করতেন। বাড়ির সামনে দিয়ে যেই নামাজে যেতেন তাকে ডেকে ডেকে ক্ষীর খাওয়াতেন। গ্রামের প্রত্যেক লোকেদের মধ্যে ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। আজ সে সব কিছুই চোখে পরে না। বাবার বয়সি লোকেরা তাদের শৈশবকে মিস করেন। আমরা করি একান্নবর্তী পরিবার ভাঙার আফসোস। স্মৃতি খুব বেদনাময়। প্রতি বছর সংসারে যোগ বিয়োগের হিসাব নিকাশ বেড়েই চলেছে।
গত বছর পরিবারের যে বৃদ্ধমানুষটিকে গোশল করিয়ে দিয়ে নতুন কাপড় আর খোশবু লাগিয়ে দিয়েছিলাম সে আজ কোথায় যেন লুকিয়ে আছে,কোন এক আকাশের নিচে,আমায় ছেড়ে হারিয়ে গেছে মনের দেয়ালে আঙুলের ছাপ ফেলে।
শত চেষ্টাতেও তার হাসিমাখা মুখ আর চোখের সামনে আসে না। এমনটাই হয়,সময়ের কালক্ষেপনে আমরা হারিয়ে ফেলি মুল্যবান অনেক কিছু।থেকে যায় শুধু স্মৃতি।সেই স্মৃতিগুলোই হয়ে থাকে আমাদের বেঁচে থাকার মুলমন্ত্র।
ঈদের মতো এমন খুশির দিনে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব না করে,ধনী দরিদ্র সকলে মিলে মেতে উঠি ঈদের আনন্দে।
সকলের ঈদ ভালো কাটুক এই প্রত্যাশায় সবাইকে জানাই ঈদের শুভেচ্ছা।
“ঈদ মোবারক”