ফিলিস্তিনে বিদেশী ইয়াহূদীদের অন্যায় ও অবৈধ অভিবাসনের শুরু থেকেই মুসলিম-খৃস্টান নির্বিশেষে সেখানকার মূল অধিবাসী আরব ফিলিস্তিনীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। এ প্রতিবাদেরই অংশ হিসেবে, ১৯৪৮ সালে যায়নবাদীদের দ্বারা ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বেও যেমন যায়নবাদীদের ও আরবদের মধ্যে বহু বার যুদ্ধ ও সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছে, তেমনি ইসরাঈল প্রতিষ্ঠার পরেও তা অব্যাহত রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে যায়নবাদীদের নিয়ন্ত্রিত মতলববাযী প্রচারণার ফলে বিশেষ করে পাশ্চাত্যের জনগণের মধ্যে একটি ধারণা তৈরী হয়েছে যে, ফিলিস্তিনীরা অন্যায়ভাবে ইসরাঈলকে উৎখাত করতে চাইছে। ইসরাঈল ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর যত হত্যা ও ধ্বংসই চাপিয়ে দিক না কেন তারা মনে করছে যে, ইসরাঈল আত্মরক্ষার জন্য এ সব পদক্ষেপের আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের একটা বিরাট যুক্তি হচ্ছে, একটি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাঈলেরও টিকে থাকার অধিকার আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি তাই?
আমাদের মতে, এ যুক্তি আদৌ সঠিক নয়। কারণ, রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাঈল একটি স্বাভাবিক ও বৈধ রাষ্ট্র নয়, বরং একটি কৃত্রিম অবৈধ রাষ্ট্র।
সাম্প্রতিক এক শতাব্দীর ইতিহাস সম্পর্কে অবগত যে কারোই জানা আছে যে, ফিলিস্তিনের বুকে উপনিবেশবাদী বৃটেন ও আন্তর্জাতিক যায়নবাদী সংস্থার ষড়যন্ত্রের ফলে অ-ফিলিস্তিনি ইয়াহূদীদের অভিবাসনের মাধ্যমে সেখানে ইয়াহূদীদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর যেহেতু ফিলিস্তিনি জনগণ কখনোই অ-ফিলিস্তিনি ইয়াহূদীদের ফিলিস্তিনে অভিবাসনের পক্ষে সম্মত ছিলো না সেহেতু বিতর্কাতীতভাবে এ অভিবাসন ছিলো অবৈধ।
ফিলিস্তিনের বুকে ইয়াহূদীদের জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে যে যুক্তি উপস্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিকভাবে ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তার আদৌ কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই।
তাদের দাবী অনুযায়ী (বর্তমানে প্রাপ্তব্য বিকৃত তাওরাতের ভাষ্য অনুযায়ী) সদাপ্রভু হযরত ইবরাহীম (‘আঃ) কে তাঁর বংশধরদেরকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং এর ভিত্তিতে এক সময় তারা এ ভূখণ্ড জয় করতে পেরেছিলো। কিন্তু এখন থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে তারা ফিলিস্তিন হতে বিতাড়িত হয়। এই দীর্ঘ সময় তারা এ ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ ফিরে পাবার জন্য অপেক্ষা করে এবং এরপর যখন তাদের হাতে সুযোগ এসেছে তখন তারা সেখানে ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে।
ইয়াহূদীরা নিজেদের ইতিহাসকে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর সাথে সম্পৃক্ত করে দেখায়, যদিও একটি ধর্মের অনুসারী হিসেবে তাদের হযরত ইবরাহীম (‘আঃ)-এর উত্তরসূরি হবার দাবী যুক্তির খাতিরে মেনে নেয়া গেলেও একটি ধর্মের অনুসারী হিসেবে সমস্ত ইয়াহূদীকে তাঁর বংশধর হিসেবে দাবী করা নেহায়েতই একটি প্রমাণ-অযোগ্য হাস্যকর দাবী। অন্যদিকে কেবল হযরত ইসরাঈল (‘আঃ)-এর [হযরত ইয়াকুব (‘আঃ)-এর অপর নাম] বংশধর বনী ইসরাঈলই হযরত ইবরাহীম (‘আঃ)-এর বংশধর নয়, বরং হযরত ইসমাঈল (‘আঃ)-এর বংশধর বনী ইসমাঈলও হযরত ইবরাহীম (‘আঃ)-এর বংশধর। অন্যদিকে হযরত ইয়াকুব (‘আঃ)-এর ভাই ‘ঈসূ-র বংশধররাও হযরত ইবরাহীম (‘আঃ)-এর বংশধর। তাছাড়া হযরত ঈসা (‘আঃ) বনী ইসরাঈলের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন এবং বনী ইসরাঈলের বেশীর ভাগই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলেও একটি অংশ তাঁর দাওয়াত কবূল করে নেয়, যারা পরে খৃস্টান নামে পরিচিত হয়। আর পরবর্তীকালে এদের উত্তরসূরিদের একাংশ ইসলাম গ্রহণ করে। তেমনই ইয়াহূদীদের থেকেও কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করে। সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে হযরত ইবরাহীম (‘আঃ)কে তাঁর বংশধরদেরকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দান করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়ে থাকলে তা মুসলমান, খৃস্টান ও ইয়াহূদী এ তিন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যকার তাঁর বংশধর সকলের বেলায়ই প্রযোজ্য, যদিও বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনে কোনো ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত কোনো প্রতিশ্রুতির কার্যকরিতা স্বীকৃত নয়।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বনী ইসরাঈল ফিলিস্তিনের আদি জনগোষ্ঠী ছিলো না। বরং ফিলিস্তিনের আদি জনগোষ্ঠী ছিলো কেনআনী আরবরা। খৃস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের শুরুর দিকে তারা ফিলিস্তিনে এসে বসবাস করতে শুরু করে। এ কারণে এরপর থেকে এ ভূখণ্ডটি কেনআন নামে পরিচিত হয়েছিলো। পরবর্তীকালে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী সিসিলি থেকে সেখানে এসে বসবাস করতে থাকে, তবে তারা কেনআনীদের সাথে মিশে গিয়ে আরবে পরিণত হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত ইবরাহীম (‘আঃ)-এর জন্ম প্রাচীন ইরাকের ব্যাবিলনে। ব্যাবিলনের অধিবাসী মূর্তিপূজারীরা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেয় নি, বরং তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে রক্ষা করেন। এরপর আল্লাহ্ তা‘আলার নির্দেশে তিনি হিজরত করে ফিলিস্তিনের শাকীমে উপনীত হন। সেখান থেকে এক সময় তিনি মিসরে গমন করেন এবং বহু ঘটনার পর তিনি মিসর হতে ফিলিস্তিনে এসে বসবাস করতে থাকেন। সেখানে তাঁর মিসরীয় স্ত্রী হযরত হার্জা (বাংলাভাষীদের মধ্যে যিনি ‘হাজেরা’ নামে পরিচিত) (‘আঃ)-এর গর্ভে হযরত ইসমাঈল (‘আঃ)-এর জন্ম হয়। পরে তিনি আল্লাহ্ তা‘আলার নির্দেশে তাঁর স্ত্রী হাজার (‘আঃ) ও পুত্র ইসমাঈল (‘আঃ)কে পবিত্র মক্কায় ক্বাবাহ্ গৃহের পাশে বসতি করিয়ে যান। এরপর ইসমাইল (‘আঃ) ও তাঁর মাকে কেন্দ্র করে সেখানে একটি জনবসতি গড়ে ওঠে। আর হযরত ইসমাঈল (‘আঃ)-এরই অধঃস্তন বংশধর হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)।
হযরত ইবরাহীম (‘আঃ) তাঁর মিসরীয় স্ত্রী হযরত হাজার (‘আঃ) ও পুত্র হযরত ইসমাঈল (‘আঃ)-কে মক্কায় রেখে আসার পর তাঁর প্রথমা স্ত্রী সারাহ্ (‘আঃ) ও তাঁর গর্ভজাত শিশুপুত্র হযরত ইসহাক (‘আঃ) যিনি ছিলেন হযরত ইসমাঈল (‘আঃ)-এর চেয়ে চৌদ্দ বছরের ছোট-সহ ফিলিস্তিনে বসবাস করতে থাকেন। এ সময় তিনি যে এলাকায় বসবাস করেন তা বর্তমানে হেবরন নামে পরিচিত (মুসলিম শাসনামলে যার নাম ছিলো আল্-খালীল)।
পূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত ইসহাক (‘আঃ)-এর পুত্র হযরত ইয়াকুব (‘আ)-এর অপর নাম ছিলো হযরত ইসরাঈল (‘আঃ)। এ কারণে তাঁর বংশধরদেরকে বনী ইসরাঈল বলা হয়। কিন্তু তারা কখনোই ফিলিস্তিনে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিলো না।
কোরআন মজীদ ও বাইবেলের বিবরণ অনুযায়ী হযরত ইয়াকুব (‘আঃ)-এর পুত্র হযরত ইউসুফ (‘আঃ) তাঁর ভাইদের দ্বারা পরিত্যক্ত শুষ্ক কূপে নিক্ষিপ্ত হয়ে মিসরে নীত হন। সেখানে বিভিন্ন ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে তিনি মিসরের খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। ঐ সময় মিসরে ও পার্শ্ববর্তী কেনআনে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে খাদ্যের সন্ধানে প্রথমে হযরত ইউসুফ (‘আঃ)-এর ভাইয়েরা ও পরে তাঁর পিতা-মাতাও মিসরে এলে হযরত ইউসুফ (‘আঃ)-এর অনুরোধে তাঁরা মিসরেই থেকে যান। এভাবে বনী ইসরাঈলের আর কেনআনের সাথে কার্যতঃ কোনো সম্পর্ক থাকে নি। স্মর্তব্য যে, তারা স্বেচ্ছায় মিসরে স্থানান্তরিত হয়েছিলো, কেউ তাদেরকে বিতাড়িত করে নি।
বনী ইসরাঈল মিসরে স্থানান্তরিত হবার প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছর পর এ বংশে হযরত মূসা (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালে মিসরের ফির‘আউন্ বনী ইসরাঈলের ওপর যুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছিলো। ফির‘আউন হযরত মূসা (‘আঃ)-এর ওপর ঈমান আনতে অস্বীকার করে এবং বনী ইরাঈলের ওপর যুলুম-নির্যাতন অব্যাহত রাখে। তখন আল্লাহ্ তা‘আলার নির্দেশে হযরত মূসা (আঃ) তাঁর অনুসারীদের নিয়ে খৃস্টপূর্ব ১২২১ অব্দে মিসর ত্যাগ করে সীনাইতে চলে আসেন। পরে বনী ইসরাঈল সীনাই থেকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে চলে আসে।
ফিলিস্তিনে আসার প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর পর হযরত শামুয়িল (‘আঃ)-এর সময় তালূতের নেতৃত্বে যুদ্ধ করে তারা ফিলিস্তিনিদেরকে পরাজিত করতে ও তাদের নিকট থেকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দখল করে নিয়ে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তবে ঐ সময় ফিলিস্তিনে যে সব জাতিগোষ্ঠীর লোক প্রাচীনকাল থেকে বসবাস করে আসছিলো ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার মধ্যে তারাই ছিলো সংখ্যাগুরু। অবশ্য তাদের অনেকেই ইয়াহূদী ধর্ম গ্রহণ করে। এভাবে ইয়াহূদী ও বনী ইসরাঈল আর সমার্থক থাকে নি।
ফিলিস্তিনে বনী ইসরাঈলের একক রাষ্ট্র সত্তর বছরের বেশী স্থায়ী হয় নি। হযরত সোলায়মান (‘আঃ)-এর ইন্তেকালের পর পরই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ইসরাঈল ও ইয়াহূদীয়াহ্ নামে দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরপর অ্যাসিরিয়ার রাজা সারগুণ খৃস্টপূর্ব ৭২১ অব্দে ইসরাঈল দখল করে নেন। এরপর খৃস্টপূর্ব ৫৯৮ অব্দে ব্যাবিলনের রাজা বাখতে নাছর (ইংরেজীতে যাকে নেবুচাদনেজার বলা হয়) বায়তুল মুকাদ্দাস (জেরুজালেম) দখল করেন এবং খৃষ্টপূর্ব ৫৮৭ অব্দে ইয়াহূদীয়াহ্ রাজ্যও দখল করে নেন। এ সময় ইয়াহূদীদেরকে ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনের বাইরে নির্বাসিত করা হয়।
খৃস্টপূর্ব ৫৩৯ অব্দে পারস্যে শাহ্ সাইরাসের হাতে ব্যাবিলনের পতন হয়। তিনি ইয়াহূদীদেরকে ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দেন।
খৃস্টপূর্ব ৬৩ অব্দে রোমান সেনাপতি পম্পেই ফিলিস্তিন দখল করেন; তিনি সেখানে ইয়াহূদী প্রশাসক নিয়োগ করেন। কিন্তু এর এক শতাব্দী পরে ইয়াহূদীরা রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কিন্তু রোমান সেনাপতি টিটুস কঠোরভাবে এ বিদ্রোহ দমন করেন। এ সময় হাজার হাজার ইয়াহূদীকে দাস বানানো হয় এবং বাকীদেরকে নির্বাসিত করা হয়। এ ঘটনার পর ফিলিস্তিনে কদাচিৎ ইয়াহূদীদের দেখা মিলতো।
এরপর ৬৩৮ খৃস্টাব্দে এক শান্তিচুক্তির মাধ্যমে বায়তুল মুকাদ্দাস যখন মুসলিম শাসনে আসে তখন খৃস্টানদের দেয়া অন্যতম ৬ শর্ত ছিলো এই যে, সেখানে কোনো ইয়াহূদীকে বসবাস করতে দেয়া যাবে না। তখন থেকে মুসলিম শাসনামলে ইয়াহূদীদেরকে বায়তুল মুকাদ্দাসে যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আসতে দেয়া হলেও তাদেরকে বসবাসের অনুমতি দেয়া হয় নি। বিশেষ করে যেহেতু মুসলমানরা তাদেরকে বিতাড়িত করে নি সেহেতু তাদেরকে সেখানে বসবাসের অনুমতি না দেয়া কোনোভাবেই অন্যায় ছিলো না, বিশেষ করে মুসলমানরা যখন এ শর্তে সেখানকার শাসনাধিকার গ্রহণ করেছিলেন।
ইতিহাসের এ আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, ফিলিস্তিনে ইয়াহূদীদের কোনোই ঐতিহাসিক অধিকার নেই। কারণ, তারা না সেখানকার মূল অধিবাসী, না তারা কখনো সেখানে সংখ্যাগুরু ছিলো এবং সেভাবে বনী ইসরাঈলের শাসনামলও সুদীর্ঘ কাল ছিলো না, বরং মুসলমানদের শাসনামলই ছিলো সুদীর্ঘ কাল (প্রায় বারোশ’ বছর) যদিও শাসনামল নয়, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হওয়াই কোনো ভূখণ্ডে কোনো জাতির বসবাসের অধিকার হিসেবে গণ্য হতে পারে। অন্যদিকে আরবরা কেনআনী হওয়ার সূত্রে এবং ফিলিস্তিনিরা তাদের মধ্যে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলো বিধায় আরবরাই ফিলিস্তিনের ভূমিপুত্র হিসেবে গণ্য হওয়ার অধিকারী।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে বৃটিশরা ফিলিস্তিন দখল করলে তাদের সাথে যোগসাজস করে যায়নবাদীরা পৃথিবীর সর্বত্র থেকে অ-ফিলিস্তিনি ইয়াহূদীদেরকে ফিলিস্তিনে নিয়ে আসে এবং ১৯৪৮ সালের ১৫ই মে বৃটিশ শাসন অবসানের সাথে সাথে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়, যদিও তখনো ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার মাত্র শতকরা ৩২ ভাগের মতো ছিলো ইয়াহূদী।
ফিলিস্তিনি জনগণ ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ও তার আগে-পরে অ-ফিলিস্তিনী ইয়াহূদীদের এনে সেখানে বসতি স্থাপন করানোর বিরুদ্ধে শুরু থেকেই নিরস্ত্র রাজনৈতিক ও সশস্ত্র উভয়ভাবেই প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। অন্যদিকে বায়তুল মুকাদ্দাস ইসলামের প্রথম ক্বিবলা বিধায় ফিলিস্তিন সমস্যা কেবল ফিলিস্তিনি জনগণের সমস্যা নয়, বরং গোটা মুসলিম উম্মাহ্র সমস্যা। তাই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) রমযান মাসের শেষ শুক্রবারকে আন্তর্জাতিক ক্বুদ্স্ দিবস ঘোষণা করেন। এছাড়া ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রেরণায় গড়ে ওঠা সংগ্রামী সংগঠন লেবাননের হিযবুল্লাহ্ ও গাযার হামাস ইতিমধ্যেই বিভিন্ন যুদ্ধে ইসরাঈলকে লাঞ্ছিত করে ইতিহাস তৈরী করেছে। তেমনি হামাস প্রতিষ্ঠার সমসময়ে সূচিত ফিলিস্তিনি জনগণের নযীর বিহীন গণ-অভ্যুত্থান ইন্তিফাদা এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এ সব থেকে সুস্পষ্ট যে, ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামকে কখনোই দমানো যাবে না। তাই আন্তর্জাতিক মহল যদি ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবী মেনে নিতে অগ্রসর না হয় তাহলে মুসলিম উম্মাহকে অবশ্যই এ লক্ষ্যে সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং নিলে তা যে সফল হবে হিযবুল্লাহ্ ও হামাসের সাফল্যসমূহ দৃষ্টে সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।
উপসংহারে বলতে চাই, ফিলিস্তিন সমস্যার একমাত্র ন্যায়সঙ্গত সমাধান হচ্ছে, পুরো ফিলিস্তিন ভূখণ্ড জুড়ে একক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা যেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে বৃটিশদের দ্বারা অধিকৃত হওয়ার সময় ফিলিস্তিনে মুসলিম, খৃস্টান ও ইয়াহূদী নির্বিশেষে যারা বসবাস করতো তাদের বংশধররা নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সমান রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করবে। অতঃপর সেখানে বহিরাগত অভিবাসী অ-ফিলিস্তিনি ইয়াহূদীদের ও তাদের বংশধরদের বসবাসের সুযোগ দেবে কিনা সে সম্পর্কে ফিলিস্তিমি জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে।
লেখক
মুহাম্মাদ আবূ মুরাদ