সন্ধ্যার ম্লান আলোতে বসে নিজের জীবনের কথাই ভাবছে আজ আবির।জীবন স্মৃতির পাতাগুলো হিজিবিজিতে ভরা থাকলেও আজ শুধু নিজের জীবনকে নিয়ে ভাবতেই তার ভালো লাগছে।আর সবার মতো তার জীবনটাও ধন্য হয়ে উঠত স্বার্থক হয়ে উঠত যদি নুশি তার পাশে থাকতো।
একদিনের দেখা সেই তরুণী তার জীবনে একটা উলট পালটের দোলা লাগিয়ে দিয়েছিল। সেদিনো এমনি সন্ধ্যা ছিল,শহরের জনবহুল পথে এমনি কোলাহলে ভরে উঠেছিল। সেই কোলাহল মুখর পথের একটি দ্বিতল গৃহে সে দিন যেন কার চরণ ধ্বনি বেজে উঠেছিল আবিরের বুকে।আজও তার সেই আসা যাওয়ার চরণ ধ্বনি বেজে ওঠে।
রাত্রির অন্ধকার ধীরে ধীরে নিবিড় হয়ে আসছে,আসুক অনন্ত এই অন্ধকারকে ব্যঙ্গ করে আবার এ ভাঙা ঘরে আলোক জ্বালাতে ইচ্ছে নেই আবিরের। মাঝে মাঝে নিজের পাগলামির কথা ভেবে নিজেই অবাক হয় আবির,নুশির সাথে দেখা করার জন্য কত অসম্ভক কাজই না করেছিল সে। দুঃখ টা আবিরের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল সেদিন,যেদিন পরীক্ষা শেষে বাবার কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছিল সে। কিন্তু একবার ও নির্জন সাক্ষাতের সুযোগ মেলেনি। কত রাতে যে নুশিকে ভেবে কাটিয়েছে আবির তার ঠিক নেই। কিন্তু সে সব তার কাছে আজ ভারী আশ্চর্যের বিষয়। আবির জানে তার অভাবে পৃথিবীতে কারো তেমন ক্ষতি হবে না তবুও সে ভাবে হয়তো এখনো সে আমায় মনে করে,এখনো বুঝি আমায় ভালোবাসে,এখনো বোধহয় সে আমায় ভুলেনি,সত্যি কি তাই?
পিতার কাছে এসে কিছুদিন ঠিক ছিলো না ,হঠাৎ ঠিক হয়ে যায় আর পাঁচদিন পর আবিরকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে কানাডা,উচ্চশিক্ষা অর্যনের জন্য। তখন ছিলো বৈশাখ মাস,আকাশ অন্ধকার করে মেঘ জমেছে,মাঝে মাঝে কারো অন্ধকারের বুক চিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে,চারিদিকে কালবৈশাখী ঝড়ের সাথে আবিরের বুকে বইছে সাইক্লোন। আবীরের জীবনতরী কুলহারা, শুধু ঘুরছে আর ঘুরছে।
অবশেষে কানাডায় পৌছালো আবির,সবকিছু এলোমেলো লাগছে তার তবুও বাঁচার তাগিদে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।
নুশির তেমন স্মৃতি আবিরের কাছে ছিল না ছিল মাত্র একটা গ্রুপ ছবি তার পরিবারের সাথে।সেটাই একমাত্র অবলম্বন তার।অনেক প্রতিক্ষায় থাকার পরো একটা চিঠিও পাঠায়নি নুশি।
সেদিন ছিলো ২০এ সেপ্টেমর,নুশির জন্মদিন। গত জন্মদিনেও তারা দুজন পাশাপাশি ছিল,উপহার হিসেবে আবির তাকে কাছে টেনে দিয়েছিলো একটা উষ্ণ চুম্বন,আজ সে সব কল্পনা মাত্র। নুশির জন্মদিনের উপহার আর চিঠি পার্শেল করে পাঠিয়ে দিলো। তারপর একমাস কেটে গেল একদিন দুপুরে কলেজ লাইব্রেরীতে বসে আবির পড়ছিল,পিয়ন এসে একটা রেজিস্ট্রি পার্শেল তাকে দিয়ে গেল। আশ্চর্য হয়ে গেল আবির এবং দেখলো সেই পার্শেলটা ফিরে এসেছে ,উপরে লেখা Returned With Many Thanks,তলায় লেখা আছে তার বাপের নাম।
এর পরের কথা ভাষায় প্রকাশ করার মতো ছিলো না,কিন্তু আবিরের কলেজের অধ্যক্ষ আর বন্ধুদের সহায়তায় নিজেকে সামলে নিয়ে খুব ভালো ফলাফল করে কানাডা জীবনের ইতি টেনে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে আবির। দেশে এসে মামার বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়,সেই পথ,সেই গাছ,সেই ঘন ঘন বাড়ি সবই চেনা । কিন্তু শহরটা যেন আশ্চর্য রকম বদলে গেছে। আঁকা বাঁকা পথদিয়ে ট্যাক্সি চলছে আর চারদিক আবিরকে ঘিরে হেসে উঠেছে কারা জানি। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে আজ পাখিরা নেচে উঠলো,আকাশের মৌনতায় আর আকুল দখিনা বাতাসে মেঘের কালো বুক রঙ্গিন হয়ে উঠেছে। প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে আবির পৌছে গেছে নুশির মামার বাড়ি,যেটা আবিরের ও মামার বাড়ি,কেননা নুশি আবিরের খালাতো বোন।
ট্যাক্সির ভারা চুকিয়ে দিয়ে আবির রওনা হলেন বাড়ির দিকে। জনা পাঁচেক ছেলে মেয়ে ছুটে এলো। সাথে আবিরের বড় মামা। পরিচয়কালে জানতে পারলো একটা ছিলো নুশির ছোট ভাই। নিজের নাম পরিচয় দিতেই সে আবিরকে জড়িয়ে ধরেছিল আনন্দে। তার কাছেই জানতে পারলো নুশি এখানেই আছে আর তার বিয়ে হয়ে গেছে।
বাড়ির উঠোনে এসে আবিরের মামা উচ্চকন্ঠে বললো,আলোটা একবার দেখাও তো মা,এদিকে যে অন্ধকার হয়ে আছে। লন্ঠনহাতে নুশি এসে দাড়ালো,আলো তুলে চাইতেই স্তম্ভিত হয়ে গেল,আবির কাছে গিয়ে হাতটা তুলে নিয়ে বললো কেমন আছো? চিনতে পারো? নুশির হাতখানা কাপছে,আলোটা হঠাৎ হাতথেকে পড়ে গেল,আবির তারাতারি সেই অন্ধকার থেকে বাইরে এসে জোৎস্নার প্লাবিত ধরণীর বক্ষে দুর্বাঘাসের উপর বসলো। আর ভাবছে কেন এমন হয়?কেন মানুষ ভালোবাসে?আবার কেনই বা তাকে পায় না?
এমন সময় পিছনে কার পায়ের শব্দ পেল,পিছন ফিরে দেখলো নুশি এসেছে,আবির দাড়াতেই নুশি আর্ত্তস্বরে বললো,কেন তুমি ফিরে এলে?কেন আমায় দেখা দিলে ,তুমি ফিরে যাও?আবির সহজ শান্তকন্ঠে বললো,আমায় ভয় কি?কি ভয় তা ভাষায় বোঝাবার নয়,নুশির হৃদপিন্ড পিঞ্জারি ভেদ করে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। নুশি অন্তিম নিঃশ্বাসের মতো বলে তোমায় ভয় নয়,তুমি মহৎ,তুমি পবিত্র,তোমার নীরব আত্মত্যাগ বড় কঠিন।বড় ভয়ানক,তাতেই মনকে মুগ্ধ করে,ভীত করে।তোমার পায়ে পড়ি তুমি ফিরে যাও,আমার জীবনটা সফল হতে দাও।
আবির প্রশান্ত গম্ভীর দৃষ্টিতুলে আকাশের হাস্যজ্জ্বল চাঁদের দিকে চেয়ে রইলো। অস্পষ্ট কুয়াশা ভেদ করে,কঠিন পাহারের বুক ভেদ করে,যে নির্মম সত্য আবিস্কার হলো,তাতেই অভিমান কি অনুতাপ কি!জীবনের ভুল ভ্রান্তি অপরাহ্নের নিকট আবিরের যা কিছু দেনা পাওনা ছিলো,তা কড়াক্রান্তি হিসাব মিলিয়ে হাতে হাতে চুকিয়ে নিয়েছে। এখন অপ্রত্যাশিতভাবে আগত এই উপরি পাওনাটুকু যখন এসেছে তখন অবশ্য প্রাপ্য বলে একে নতশিরে গ্রহণ করতে হবে,তাতে ক্ষোভ কি।
নিজেকে সামলে নিয়ে আবির বললো তবে এই শেষ,আজ এখনই জন্মের মতো এ দেশ ছেড়ে যাবো,আর ফিরবোনা, আমার মা কে সান্ত্বনা দিও। খোদা তোমাকে শান্তি দিক তুমি সুখি হও।দুজনে কথা দিয়েছিলাম তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না, তুমিও কথা দিয়েছিলে,কিন্তু রাখতে পারোনি আমি রেখেছি,আর যতদিন জীবত থাকবো রাখবো।
নুশি বললো কি করবো,আমি মেয়ে মানুষ অবলা জাতি,বাবা-মার কথার উপর আমাদের কথা খাটে না,আমরা যে প্রান থাকতেও নিঃপ্রান।আমাকে ক্ষমা করো,ওগো আমায় ক্ষমা করো।
নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে আবির বললো আচ্ছা বেশ,দোয়া করি তুমি সুখী হও।তবে ক্ষমা,না দেবী এর মাঝে ক্ষমা নেই।এতো হৃদয়হীন ছেলে খেলার পরিতাপের কুটুম্বিতা নয়। এ যে প্রাণের গোপন পুরে প্রাণের আদর্শ পুজার উন্মাদ সাধনা। এতে যদি পাপ থাকে,তবে তার শাস্তিও আছে।কিন্তু ক্ষমা? না,ক্ষমা নেই।
এরপর আবির চলে এসেছে,সে জানেনা তার পর কি হয়েছে।সেটা মস্ত বড় একটা জিজ্ঞাসার চিহ্নের (?) মত রয়ে গেছে! তাকে বলবার কেউ নেই কি?যদি কেউ থাক,বলে দিও___
লিখেছেনঃ জলস্পর্শী তটিনী